নতুন সূর্য কোন পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসে, সেটারই অপেক্ষায় দেশবাসী 

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
নতুন সূর্য কোন পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসে, সেটারই অপেক্ষায় দেশবাসী 

ঢাকা: টানা কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির রথ থমকে দিয়েছিল করোনাভাইরাসের মহামারী। তারপর আসে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ধাক্কা। অবকাঠামো উন্নয়নের পথ ধরে বাংলাদেশের যে গতিতে ছোটার কথা, বিশ্ব বাস্তবতার চাপে তা সম্ভব হচ্ছে না।

পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না; সর্বশেষ হিসাবে প্রবৃদ্ধি আছে এক শতাংশের উপরে, যেখানে ২০২৩ সালের জুন মাসে শেষ হওয়া অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ছয় দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে আমদানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি।

মহামারীর বিপদের দিনেও ভালো অবস্থায় থাকা প্রবাসী আয় এখন আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, সরাসরি বিদেশি বিনোয়োগও কমছে।

মূল্যস্ফীতির ‘পাগলা ঘোড়া’ থামানো যাচ্ছে না। ছয় শতাংশ নিয়ে বছর শুরু করা মূল্যস্ফীতি ২০২৩ শেষে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে; তাতে ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

রিজার্ভ কমতে কমতে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ঘর থেকে ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। আহসান মনসুর মনে করেন, রিজার্ভের এই পতন জরুরি ভিত্তিতে থামাতে হবে।

রাজনীতির উত্তাপ ফেরাল নাশকতা
মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নিরুত্তাপই ছিল। ২০২৩ সালে ভোট প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনাও ফেরে।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ধপে ধাপে রাজপথের কর্মসূচি বাড়াতে থাকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও পাল্টা করমসূচি নিয়ে মাঠে থাকায় ছড়াতে থাকে উত্তাপ।

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি বছরজুড়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে এলেও ২৮ অক্টোবর তাদের মহাসমাবেশ সহিংসতার রূপ নেয়। সংঘর্ষের মধ্যে মহাসমাবেশের ইতি টেনে পরদিন সারাদেশে হরতালের ডাক দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। হরতালের মধ্যে মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এরপর ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ পালন করে বিএনপি।

এরপর ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে হরতাল ও অবরোধ। এসব কর্মসূচি ঘিরে যানবাহনে আগুনের ঘটনা ফিরিয়ে আনে এক দশক আগের একই রকম নাশকতার স্মৃতি।

ফায়ার সার্ভিসের হিসাব বলছে, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের সারা দেশে প্রায় তিনশ যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেনে আগুন দেওয়ার এক ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে সেই নির্বাচনে জিতে টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ।

সেই নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে ২০১৫ সালের শুরু থেকে টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। ওই সময় পেট্রোল বোমা ছুড়ে যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় শতাধিক মানুষের প্রাণ যায়।  

এবার আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ২৭ দল ভোটে এলেও বিএনপি ও সমমনারা ভোট বর্জন করে অসহযোগের ডাক দিয়েছে। ফলে ৭ জানুয়ারির ভোট কতটা শান্তিপূর্ণ হবে, ভোটের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল থাকবে, সেই প্রশ্নগুলো নতুন বছরের শুরুতে ঘুরেফিরে আসছে জনমনে। 

মতিঝিলে একটি বেসরকারি ইন্সুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তা নাহিদা খান মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা না কাটলে, রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে ২০২৪ সালে দেশের জন্য ‘কঠিন সময়’ অপেক্ষা করছে। আর তাতে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো বাড়বে। 

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফুটপাতের ফল বিক্রেতা শহিদ মাতব্বরেরও আশঙ্কা, তার মত ছোট পূঁজির মানুষদের জন্য সামনের দিনগুলো হয়ত সুখকর হবে না।

তিনি বলেন, “ফুটপাতে যারা বাজার-সদাই করেন, তাদের পকেটের অবস্থা ভালো না। সোজা কথায় বলি, আমাদের যারা গ্রাহক, তাদের অবস্থা কাহিল হলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে বুঝতেই পারছেন।” 

‘নিশ্চিত-অনিশ্চিত’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর ভাষায়, “আমরা স্থিরভাবে বলতে পারি- আগামী বছরটা অস্থির যাবে। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আগামী বছরটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে। কারণ বছরটা শুরু হতে যাচ্ছে রাজনীতিতে বড় ঘটনা জাতীয় নির্বাচন দিয়ে।

“এ নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী ৫ বছরের সরকার গঠন হবে…. বড় একটি দল বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচনের যে প্রস্তুতি রয়েছে সেটাও একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতার অধিকারীরা ঠিক করছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটের পর ক্ষমতাসীনদের সহায়তা নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা আলোচিত হয়েছে।”

তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পশ্চিমা শক্তিগুলো বাংলাদেশের ওপর যে চাপ দিচ্ছে, তার সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক বিষয় যুক্ত।“তারা এ এলাকায় তাদের পক্ষে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় খুব মনোযোগ দিচ্ছে। আমরা দেখছি, এতে দেশের ভেতরে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তৈরি হবে।” 

৭ জানুয়ারি ভোট, তারপর কী? 
এই রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারের ধারণা, নতুন বছরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা দেখতে পারে বাংলাদেশ।“সেটা ভূরাজনৈতিক কারণে হতে পারে। কিন্তু সেটা আমরা জটিল করে তুলেছি আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঘিরে। আর অর্থনৈতিক সঙ্কটও আসতে পারে। রাজনৈতিক অনৈক্য, সংঘাত এবং বিশৃঙ্খলা আরও বেশি আমন্ত্রণ করেছি আমরা।”

অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার অবশ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতার ততটা শঙ্কা দেখছেন না। বরং তিনি দ্রব্যমূল্য ও বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরার তাগিদ দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, “আমি মনে করি, পলিটিক্যাল অপজিশন নিয়ে আগামীতে তেমন কিছু আর হবে না; এক ধরনের জায়গায় থাকবে, কন্ট্রোলড একটা জায়গায় থাকবে। কিন্তু বৈষম্য যেভাবে বাড়ছে, সেটার লাগাম টেনে না ধরলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষকের ভাষায়, নতুন বছরেও সমাজের একটি অংশ ‘নাখোশ’ থাকবে, এটা বাস্তবতা। এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে।

“নাখোশ থাকা এক কথা, আর অস্থিতিশীলতায় মদদ তৈরি করা অন্য বিষয়। আশা করা যায়, ক্ষমতাসীন হোক আর বিরোধী পক্ষ হোক, সবাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধরে রাখবে।”

রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে অন্য অনেক জরুরি বিষয় যে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান শান্তনু মজুমদার।

তিনি বলেন, “দ্রব্যমূল্য ও খাবারের ভেজালের বিষয়টি আমাদের একেবারে শেষ করে দিচ্ছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্র যদি সচেষ্ট হয়, মানুষের জীবনটাকে আরও অনেক সহনীয় করা সম্ভব। সারাক্ষণ রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক, মারামারি ছাড়াও জনজীবনকে শান্তিতে, স্বস্তিতে রাখা বড় কর্তব্য।”

তবু আশায় বসত
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার একের পর এক মাইলফলক পেরিয়ে এসেছে। অবকাঠামো উন্নয়নের বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় ২০২৩ সালেই তার সুফল পেতে শুরু করেছে মানুষ। 

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল উদ্বোধনের পর সেই সুড়ঙ্গ পথে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে তিন মিনিটে আনোয়ারায় পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ঢাকার যানজটে স্বস্তি দিতে খুলে দেওয়া হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ।

এআর

Link copied!