ঢাকা: দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অবিস্মরণীয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার।
জীবিতদের পাশাপাশি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারও এসব ভাতা ও অন্যান্য সম্মানী পাচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারাও এতে সন্তুষ্ট। তবে এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি না হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে অনেকের মধ্যে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত, শারীরিক অসামর্থ্যসহ নানা দিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা এবং রেশন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ ৬ মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাবদ ৩৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
সম্মানী ভাতা ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২ লাখ ৪০ হাজার ১৭৩ জন সম্মানী ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। বর্তমানে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বছরে ১০ হাজার টাকা করে দুটি উৎসব ভাতা, ২ হাজার টাকার বাংলা নববর্ষ ভাতা এবং ৫ হাজার টাকার বিজয় দিবস ভাতা পান। অর্থাৎ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অন্য সুযোগ-সুবিধা বাদে বছরে ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন।
খেতাবপ্রাপ্তদের আলাদা সম্মানী
সম্মানী ভাতা বিতরণ আদেশ ২০২০ অনুযায়ী, ৬৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ ভাতা দিচ্ছে সরকার। বীরশ্রেষ্ঠ ৩০ হাজার, বীর উত্তম ২৫ হাজার, বীর বিক্রম ২০ হাজার এবং বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা শারীরিক অসামর্থ্য অনুযায়ী চারটি ক্যাটাগরিতে ভাতা পান। ৯৬-১০০ শতাংশ শারীরিক অক্ষমদের ‘এ’ শ্রেণি, ৬১-৯৫ শতাংশ অক্ষমদের ‘বি’ শ্রেণি, ২০-৬০ শতাংশ অক্ষমদের ‘সি’ শ্রেণি এবং ১-১৯ শতাংশ অক্ষমদের ‘ডি’ শ্রেণিভুক্ত করে ভাতা দেওয়া হয়। ‘এ’ শ্রেণিভুক্তরা ৪৫ হাজার, ‘বি’ শ্রেণিভুক্তরা ৩৫ হাজার, ‘সি’ শ্রেণিভুক্তরা ৩০ হাজার এবং ‘ডি’ শ্রেণিভুক্তরা ২৭ হাজার টাকা মাসিক সম্মানী পান।
এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা, মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবারকে ২৮ হাজার টাকা করে ভাতা দেয় সরকার।
বিদেশে চিকিৎসায় ৮ লাখ টাকা
মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী যুদ্ধাহত, খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ/মৃত খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের দুই সন্তান বছরে ১ হাজার ৬০০ টাকা শিক্ষা ভাতা, দুই মেয়ে প্রতিটির বিয়ের জন্য ১৯ হাজার ২০০ টাকা, বিদেশে চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা বিশেষ ভাতা পাবেন। এ ছাড়া হুইল চেয়ারে চলাচলকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মোবাইল বিল হিসেবে মাসে ১ হাজার ১০০ টাকা এবং তাদের পথ্য বিল বাবদ মাসে ৩ হাজার ১২২ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।
বিনা ভাড়ায় যাতায়াত
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়, যা প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করতে হয়। ওই পরিচয়পত্র দেখিয়ে সরকারি যানবাহনে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারেন তারা। বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরীণ সব রুটে বছরে একবার এবং আন্তর্জাতিক রুটে বছরে দুইবার বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের সুবিধা পান।
টোল মওকুফ
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরবরাহ করা হয় মন্ত্রণালয় থেকে। হুইল চেয়ারে চলাচলকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বছরে একবার ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শনের ব্যবস্থা, পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে সড়ক ও মহাসড়কের টোল মওকুফ, ফেরিতে বিনা ভাড়ায় পারাপার, পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেলে স্ব সপরিবারে দুই রাত তিন দিন, ডাক বাংলোতে দুই দিন অবস্থানের সুবিধা দেওয়া হয়।
হোল্ডিং ট্যাক্স লাগে না
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রবিধান অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসরত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, মৃত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স এবং পানি ও পয়োনিষ্কাশন বিল মওকুফ সুবিধা পাবেন। আর সিটি কর্পোরেশন থেকে দাফনের জন্য কবরস্থানে জায়গা সংরক্ষণ, বিজয়ের মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্মিলনী ও সংবর্ধনা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার সড়কের নামকরণের উদ্যোগ রয়েছে।
মাসিক রেশন
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে রেশন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। রেশন হিসেবে চার সদস্যের একটি পরিবারকে মাসে ৩৫ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, ৫ কেজি চিনি, ৮ লিটার ভোজ্যতেল ও ৮ কেজি ডাল দেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম হলে পরিমাণ আরেকটু কমে।
খুশি মুক্তিযোদ্ধারা, চান পূর্ণাঙ্গ তালিকা
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কথা হয় ফেনী জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা ও দুই ঈদে বোনাসসহ বেশকিছু সুবিধা দেয় সরকার। বর্তমান সরকার ভালোই সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। আমাদের আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
তিনি বলেন, তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের আমলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি না হওয়া খুবই দুঃখজনক। সরকার কেন বারবার এ কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি না। আশা করি, সরকার খুব দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, মাসিক সম্মানী ভাতার বাইরেও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার ও সন্তানদের অনেক সুবিধা দিচ্ছে সরকার।
এআর
আপনার মতামত লিখুন :