ঢাকা : ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন তৎকালীন আইজিপি বেনজীর আহমেদ। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাত থেকে তার পুরস্কার নেয়ার ছবি ছাপা হয় পত্র পত্রিকায়।
বেনজীরের শুদ্ধাচার পুরস্কার কতটা শুদ্ধ ছিল সেই প্রশ্ন ইদানীং জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে তার সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন তিনি।
এছাড়া ২০১৯ সালে জামালপুরের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন আহমেদ কবীর। তিনি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভাগীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান। তার মাস দুয়েকের মাথায় নিজ কার্যালয়ে এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটানোর ভিডিও প্রকাশের জেরে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তাকে।
এসব কারণে শুদ্ধাচার পুরস্কার এবং এটি দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। কী প্রক্রিয়ায় ও কোন মানদণ্ডে এই সম্মাননা দেয়া হয় এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি কতটুকু ভূমিকা রাখছে সেসব নিয়েও কথা বলছেন অনেকে।
শুদ্ধাচার কী ও কেন?
অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে প্রথম অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০০১ সালে। আর প্রথমবারেই দেশের অবস্থান ছিল তালিকার শীর্ষে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জরিপেও বাংলাদেশ দশম স্থানে অবস্থান করছে।
এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করা হয়। সেখানে শুদ্ধাচার-এর একটি ধারণা দেয়া হয়েছে।
শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা।
এতে আরো বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচার অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, কৌশল প্রণয়ন করা হলেও এটি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি কোনো ভূমিকাও রাখতে পারেনি।
কী কী গুণ থাকতে হবে?
২০১৭ সালে শুদ্ধাচার পুরস্কারটি চালু করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ১৫টি ধাপে মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়।
এই পুরস্কার পেতে যে ১৮টি গুণাবলিকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হচ্ছে সেখানে পেশাদারিত্বের পাশাপাশি আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মতো বিষয় স্থান পেয়েছে।
পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, সততার নিদর্শন, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সহকর্মী ও সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণসহ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতা এমনকি ছুটিগ্রহণের প্রবণতাকেও রাখা হয়েছে তালিকায়। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য পাঁচ নম্বর করে ধরা হয়েছে। এতে মোট নব্বই নম্বর। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ধার্য করা অন্যান্য কার্যক্রম পালনের ওপর রাখা হয়েছে ১০ নম্বর। সব মিলিয়ে একশ।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই এ পুরস্কার প্রদানের জন্য কর্মচারী নির্বাচন করা হয়ে থাকে।
তবে এই পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে এই মাপকাঠি আদৌ মানা হয় কি না তা নিয়ে সন্দেহ অনেকের। বেশিরভাগেরই ধারণা বাছাইকরণ প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ ছিল। কারণ, যাদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া হয়েছে তাদের অনেকেই অশুদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ঢালাওভাবে এর অপব্যবহার করা হয়েছে।
পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্যতা
প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে ছয়টি বিধান যুক্ত করা হয়েছে পুরস্কারের নীতিমালায়:
১. বিবেচ্য কর্মচারীকে সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে ন্যূনতম ছয় মাস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হবে।
২. কোনো কর্মচারীর গুণাবলির সূচকের বিপরীতে প্রাপ্ত সর্বমোট নম্বরের ভিত্তিতে সেরা কর্মচারী হিসাবে মূল্যায়ন করা হবে।
৩. কোনো কর্মচারীর মোট প্রাপ্ত নম্বর ন্যূনতম ৮০ না হলে তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না।
৪. সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত কর্মচারী শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন।
৫. মূল্যায়নের পর একাধিক কর্মচারী একই নম্বর পেলে লটারির ভিত্তিতে সেরা কর্মচারী নির্বাচন করতে হবে।
৬. কোনো কর্মচারী যে কোনো অর্থবছরে একবার শুদ্ধাচার পুরস্কার পেলে তিনি পরবর্তী তিন অর্থবছরের মধ্যে পুনরায় পুরস্কার পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না।
টিআইবির মতে, মাপকাঠি ঠিক করা হলেও বাছাই করার ক্ষেত্রে যোগ্যদের সাথে বৈষম্য করা হয়েছে। এ কারণেই ইতিবাচক ফল মেলেনি।
পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেয়া হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পুরস্কারের ক্ষেত্রে অর্থের চেয়ে স্বীকৃতিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, শুদ্ধাচার কৌশল ও শুদ্ধাচার পুরস্কার নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবা উচিত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :