আলোচনার প্রস্তাব

আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভিন্ন সুর

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২৪, ০৭:০১ পিএম
আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভিন্ন সুর

ঢাকা : সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির মধ্যে সরকারের তরফে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে ‘দুই ধরনের’ সাড়া পাওয়া গেছে।

ফেইসবুকে আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক সরাসরি ‘না’ করে দিলেও একজন সমন্বয়ক বলেছেন, তারা বেশ কিছু দাবি জানাবেন, সেগুলো পূরণ হলে আলোচনা হতে পারে। তবে তিনিও বলেছেন, আলোচনা ও গোলাগুলি এক সঙ্গে চলে না।

গত মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ৬ জনের মৃত্যু এবং বুধবারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাতের পর বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ডাক আসে।

এদিনও ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে প্রাণহানির মধ্যে দুপুরে জাতীয় সংসদের টানেলে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আইন মন্ত্রী আনিসুল হক।

তিনি বলেন, সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত যখন চাইবে, তখনই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার প্রস্তুত।

আন্দোলনকারীদের আলোচনার বার্তাকে প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে আলোচনা করার জন্য আমাকে, মানে আইন মন্ত্রীকে এবং শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা তাদের সাথে বসব।

আমরা এটাও বলতে চাই, তারা যখনই বসতে রাজি হবে, এটা যদি আজকে হয় আজকেই আমরা বসতে রাজি আছি।

কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত জানিয়ে তিনি এও বলেন, কোটা নিয়ে পরিপত্র বাতিলের হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার যে আপিল করেছে, তার শুনানি এগিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, গত কয়েক দিনের সংঘাত ও প্রাণহানির সার্বিক ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করতেও প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হবে।

আমার মনে হয় আজ থেকে আন্দোলন করার কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা সেই কারণে তাদের আহ্বান জানাচ্ছি, অনুরোধ করছি, তারা যেন সহিংসতা বন্ধ করে এবং এই আন্দোলন প্রত্যাহার বা স্থগিত করে।

সরকারের তরফে আলোচনার এই প্রস্তাবে কোটা আন্দোলনকারীরা কী ভাবছেন, এই প্রশ্নে আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা কিছু দাবি জানাব। সেই দাবিগুলো পূরণ সাপেক্ষে আলোচনা হতে পারে। সেই দাবিগুলোর বিষয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। দাবিগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে লিখে আমরা লিখিত আকারে জানাব, যাতে করে ভুলভাবে আমাদের দাবি উত্থাপিত না হয়।

‘আলোচনা তো আগেও হতে পারত’ মত দিয়ে তিনি বলেন, আলোচনা আর গোলাগুলি একসঙ্গে হয় না। লাশের ওপর দিয়ে তো আলোচনায় যাওয়া যায় না।

তবে আন্দোলনকারীদের আরও কয়েকজন সমন্বয়ক ফেইসবুকে আলোচনার আহ্বানে প্রস্তাবে ‘না’ করে দিয়েছেন।

আসিফ মাহমুদ নিজে লেখেন, গুলির সাথে কোনো সংলাপ হয় না। এই রক্তের সাথে বেইমানি করার থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়।

আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম লেখেন, একদিকে গুলি আর লাশ অন্যদিকে সংলাপ! আমার ভাইয়ের রক্তের উপর দিয়ে কীভাবে সংলাপ হতে পারে?

আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, রক্ত মাড়িয়ে সংলাপ নয়।

সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১০ শতাংশ করে জেলা ও নারী কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা ছিল।

২০১৭ সালে কোটা নিয়ে আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে সরকার পরিপত্র জারি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে সব কোটা তুলে নেয়।

তিন বছর পর সাত জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের আবেদনে জুনের শুরুতে হাই কোর্ট সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর ফের আন্দোলন শুরু হয়।

গত সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচিতে সড়কে চলাচলে তীব্র ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। এর মধ্যে আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেয়। আগামী ৭ অগাস্ট এ নিয়ে আপিল বিভাগে শুনানির কথা আছে।

চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কোটার বিষয়টি সমাধান হবে আদালতে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?

সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠে।

ছাত্রলীগ ও সরকার সমর্থকরাও মাঠে নামে। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। সোমবার সংঘাত ছড়ায় ঢাকার বাইরেও। এর মধ্যে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় এক ছাত্রলীগ কর্মীসহ দুই জন, চট্টগ্রামে এক ছাত্রদল কর্মীসহ তিন জন ও রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নিহত হন।

বেগম রোকেয়ায় সংঘর্ষের সময় একটি ভিডিও ছড়ায় যেখানে দেখা যাচ্ছে আবু সাঈদ সাঈদ নামে এক ছাত্রকে লক্ষ্য করে কাছ থেকে রাবার বুলেট ছুড়ছে পুলিশ।

এই ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মধ্যে মঙ্গলবার কোনো কর্মসূচি না এলেও নানা সহিংসতা হয়। সেদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেন। বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, আদালতে শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার পাবে।

রোববারের সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় বিচারিক তদন্ত কমিটি হবে বলেও জানান তিনি।

এর মধ্যে বুধবার সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে অস্বীকার করেছে। পরদিন ঢাকায় সংঘর্ষে জড়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মাঠে নেমেছে।

তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেই কর্মসূচিতে রাতেই সমর্থন জানায় বিএনপি।

তবে হাই কোর্টের আদেশ আপিল বিভাগ স্থগিত করে দেওয়ায় এই মুহূর্তে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোনো কোটা নেই। আর সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা থাকলেও ২০১৩ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ নিয়োগ হয়েছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি। মেধা তালিকা থেকেই নিয়োগ হয়েছে ৬২ শতাংশের বেশি।

এমটিআই

Link copied!