বিদেশি চোখে দেখা ফেনীর বন্যা

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৪, ০২:২২ পিএম
বিদেশি চোখে দেখা ফেনীর বন্যা

ঢাকা : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে ফেনী জেলা। বিদেশি সাংবাদিকের চোখে দেখা সেই বন্যার বিবরণ আমাদের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হয়েছে।

ফেনী জেলা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে। কখনো পানি পৌঁছায়নি এমন জায়গায়ও কোমর অথবা বুক সমান বন্যায় ডুবে যায়। ফেনীর এ বন্যাকে বলা হচ্ছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড। তবে অন্যান্য ফ্ল্যাশ ফ্লাডের মতো এ বন্যার পানি সহজে সরে যাচ্ছে না। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে পানির তলায় আছে এখনো অনেক এলাকা।

ইতিমধ্যে ক্ষেতের ফসলসহ খামারের মাছ-মুরগি, হাঁসসহ অন্যান্য গবাদি পশু ভেসে গেছে বন্যার তোড়ে। যেসব জায়গা থেকে পানি সরছে, সেখানে ফুটে উঠছে ক্ষত। সাধারণ বাঁশ ও টিনের তৈরি ঘরবাড়ি ধসে গেছে। ঘরের ভেতর জমেছে পুরু পলির স্তর।

বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ঘরের আসবাব, খাবার যাবতীয় সঞ্চয়। হুট করে রাতের বেলা বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় সেসব তারা সরিয়েও নিতে পারেননি। এ অবস্থায় ফেনীতে বন্যার্তদের দেখতে যান যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর সাংবাদিক রেবেকা রাইট এবং আন্না কোরেন। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং ফেনীর মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তারা যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তা সিএনএন ডটকম মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) প্রকাশ করে।

বন্যার বিবরণে তারা লেখেন, বুকসমান কাদাপানি ঠেলে তারা দেখেছেন ফেনীর মানুষ মাথায় ত্রাণের দ্রব্য নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছেন। তারা কেউ এমন বন্যা কখনো দেখেননি ফেনীতে।

তারা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে বন্যায় প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কমপক্ষে ১৮ জন নিহত হয়েছে। তবে বন্যার পানি কমতে থাকলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। একই বন্যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের কর্মকর্তারা বলছেন, ত্রিপুরা অঞ্চলেও একই বন্যায় কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছে এবং ৬৪ হাজারের বেশি মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

বেঁচে আছে কি না জানি না : সিএনএন-এর দুই সাংবাদিকের প্রতিবেদন শুরু হয়েছে এভাবে, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের ফেনী শহরে প্রবেশ করতেই তারা দেখেন, বুক ছাড়িয়ে যাওয়া উচ্চতায় কর্দমাক্ত বন্যার পানি ঠেলে হেঁটে আসছে শত শত লোক। তাদের মাথায় শুকনো খাবারের ব্যাগ ধরে রাখা। এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে ফেনী। গত বুধবার রাত থেকে প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষের শহরের বড় অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে।

ফেনীতে ত্রাণ সরবরাহ এবং অসহায় মানুষদের উদ্ধারের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে পরিচালিত দুটি দলে সিএনএন-এর দুই সাংবাদিক যুক্ত হন। তারা জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় ঢোকার বা বের হওয়ার একমাত্র উপায় হলো নৌকা। সমস্ত প্রধান রাস্তা সম্পূর্ণভাবে যানবাহনের চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের অভাব এবং প্রায় সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্ল্যাকআউটে পড়ে যাওয়ায় উদ্ধার প্রচেষ্টাও কঠিন হয়ে পড়ে।

সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে ত্রাণ তৎপরতা সমন্বয় করার জন্য একত্র করা হয়।

এ ছাড়া ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণে এগিয়ে আসেন অনেকে। অনেকে আবার ফেনীতে নিজ পরিবারের সদস্যদের খোঁজে ঢাকা থেকে ফিরছেন।

ঢাকায় ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবক আবদুস সালাম (৩৫) বলেন, তার পরিবারের ১২ জন সদস্য ফেনীর কেন্দ্র থেকে ১৫ মাইল (২৫ কিলোমিটার) দূরে একটি গ্রামে আটকা পড়েছে, যার মধ্যে তার দুই বোন, ভাই এবং তাদের সন্তান রয়েছে।

তিনি বলেন, আমি জানি না তারা বেঁচে আছে কি না। তাদের কথা মনে পড়লেই আমি কাঁদি। এখানে বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, ইন্টারনেট নেই। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানান।

উদ্ধার : ফেনীতে বন্যার্তদের উদ্ধার অভিযানও বিশাল চ্যালেঞ্জে পড়েছে বলে জানায় সিএনএন। ঢাকা থেকে সাধারণত চার ঘণ্টায় ফেনী পৌঁছানো গেলেও, এখন লাগছে আট ঘণ্টা।

সারা দেশ থেকে আসা উদ্ধারকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা বন্যা অঞ্চলে প্রবেশের চেষ্টা করলে জ্যাম বেঁধে যায়। ফলে অনেকে পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে এলেও তাদের কাছে পৌঁছানোর কোনো উপায় ছিল না।

ইয়াসিন আরাফাত জানান, তিনি ঢাকা থেকে তার বাবা, মা, দাদি এবং ছোট ভাইয়ের খোঁজে এসেছেন। কিন্তু তিনি অসহায়, কারণ তার নৌকা নেই। তিনি শুনেছেন, তার গ্রামে ৩৫টি পরিবার একটি ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের মধ্যে দুই গর্ভবতী নারীও রয়েছে।

তবে শহর থেকে জলপথে তিন ঘণ্টা দূরত্বে অবস্থিত সেই জায়গায় যেতে তিনি নৌকা খুঁজে পাচ্ছেন না। নিজের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে ইয়াসিন জানান, ‘তাদের পানি নেই, খাবার নেই এবং তারা খুব ভীত, গত ৪৮ ঘণ্টায় আমি কোনো খবর পাইনি।

সিএনএন জানাচ্ছে, ফেনীর প্রধান মহাসড়ক এখন প্রধান নৌপথে পরিণত হয়েছে। হাঁটতে সক্ষম কিছু লোক কোমর বা বুক সমান উচ্চ কর্দমাক্ত পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পানিবাহিত রোগ, সাপ বা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে নিরাপদে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে তারা।

তবে যারা বন্যার গভীরতম অংশে আটকা পড়েছে, তাদের জন্য হাঁটাও অসম্ভব। তারা শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রামে আটকা পড়েছে। এমনকি এই অঞ্চলে নৌকা ভ্রমণও ঝুঁকিপূর্ণ ঘন গাছ এবং ইঞ্জিন আটকে যাওয়ার কারণে। আমাদের নৌকা একটি সরকারি ভবনের পাশ দিয়ে যায় যা উদ্ধার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে আনুমানিক ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

অন্যান্য বহুতল ভবন, একটি হাসপাতাল এবং বেশ কয়েকটি স্কুলও আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। তারা শারীরিকভাবে নিরাপদ থাকলেও খাদ্য, পানি ও ওষুধের অভাব রয়েছে। পেয়ারা আক্তার (৩৬) তার বোন তানজিনা এবং অসুস্থ নবজাতককে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

তিনি জানান, ১ মাস বয়সী শিশুটি গত কয়েকদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না এবং তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিন্তু একটি স্কুলে গিয়ে এক ঘণ্টা খুঁজেও তার বোনের দেখা পাওয়া যায়নি।

তবে তিনি বিশ্বাস করেন আক্তার তার বাড়ির পথে সিএনএনকে জানান, তার আশা তার বোন অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। কাতারের একটি হাসপাতালে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ফেনীতে জন্মগ্রহণকারী এক ব্যক্তি বন্যার খবর পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

তিনি তার ৫৫ বছর বয়সী মাকে উদ্ধারের আশায় একটি নৌকা জোগাড় করেন। কিন্তু তার অবস্থান থেকে মায়ের অবস্থান ছিল অনেক দূরে। তাদের চারজনের পরিবারে রয়েছেন মা, শিশু এবং দাদা-দাদি। অনেক লড়াই করে নৌকায় তাদের উদ্ধার সম্ভব হয়। উদ্ধারের পর দেখা গেল পরিবারের সদস্যরা ছিলেন ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। তারপরও ৬৫ বছর বয়সী দাদা মিজানুর রহমান খান বলেন, আমরা এখন খুশি। আমরা এখন নিরাপদ।

বাঁধ বিতর্ক : এ দুই সাংবাদিক বলছেন, বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে নদী ও জলপথ। মাছ ধরা এবং ধান চাষ এখানকার মানুষের অত্যাবশ্যক জীবিকার উৎস। দেশটি বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যা বেড়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা বাড়িয়ে তুলেছে। তারপরও এ বন্যা ফেনীবাসীকে অবাক করেছে এবং ‘এখানকার লোকেরা ভারতের কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেছে’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ফেনী।

সেখানকার বেশ কয়েকজন ব্যক্তি নয়াদিল্লিকে দায়ী করেছে যে তারা ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর বাঁধ থেকে কোনো সতর্কতা ছাড়া পানি ছেড়ে দিয়েছে। এ দুই সাংবাদিক যখন বন্যাকবলিত বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনো কিছু লোক চিৎকার করে ভারতের সমালোচনা করেন।

যেমন শরিফুল ইসলাম নামের ২৯ বছর বয়সী একজন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মী, যিনি ঢাকা থেকে অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে উদ্ধারকাজ শেষে ফিরছিলেন; তিনি বলেন, তারা গেট খুলেছিল, কিন্তু কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

যদিও ভারত জানিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে তারা বাঁধ ছেড়ে দেয়নি। তারা বলেছে, অত্যধিক বৃষ্টির কারণে পানির তোড়ে স্বয়ংক্রিয় বাঁধের কপাট নিজেই খুলে গেছে। বাংলাদেশের বন্যার্তদের মধ্যে এখন ক্ষোভ বাড়ছে তাদের ঘরবাড়ি প্লাবিত পানির উৎস নিয়ে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মতে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে বলেছেন, উচ্চ জলস্তরের কারণে বাঁধে একটি স্বয়ংক্রিয় মুক্তি ঘটেছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র প্রতিনিধির একজন বলেন, সতর্কতা ছাড়াই বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত অমানবিকতা প্রদর্শন করেছে।

ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার বিবৃতিতে বলে যে, ডম্বুর বাঁধ থেকে নির্গত পানিকে বন্যার জন্য দায়ী করা বাস্তবভাবে সঠিক নয়।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে প্রাথমিকভাবে বাঁধের নিচের দিকে গোমতী নদীর ওপর বৃহৎ জলাধার থেকে প্রবাহিত পানির কারণে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদীতে বন্যা একটি যৌথ সমস্যা যা উভয় পক্ষের মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং এটি সমাধানের জন্য ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

এমটিআই

Link copied!