ঢাকা: জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও লোভনীয় পদগুলোতে পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পদায়ন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না। বিগত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত এ ঘটনায় তদবিরেই ভরসা রেখেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। গত প্রায় দুই দশক ধরে নিজেদের পদোন্নতি এবং পদায়নে প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এবার একজন উপদেষ্টাও বিধি লঙ্ঘন করে তাদের পক্ষে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে আধা সরকারি পত্র দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসকল তথ্য জানা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে কর্মরত আছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা নির্মল কান্তি চাকমা। এই কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে উপানুষ্ঠানিক পত্র দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে দেওয়া পত্রে তিনি লিখেছেন, বিগত সরকারের সময় ‘সরকারের উপ-সচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২’ অনুযায়ী পদোন্নতি প্রদান না করে অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছে। জনাব নির্মল কান্তি চাকমা (পরিচিতি নং-৬৪৬৫) বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্মসচিব) হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে কর্মরত। তিনি আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। আমার জানামতে, তিনি সরকারী
চাকরি আইন -২০১৮ ও সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা আপীল বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী অভিযুক্ত নন। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে
চাকরি করার কারণে তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়নি মর্মে জানা যায়।
বর্ণিতাবস্থায় তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি প্রদান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
অপর আরেকটি উপানুষ্ঠানিক পত্রে এই উপদেষ্টা লিখেছেন, বিগত সরকারের সময় নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে অনেক যোগ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়নি। তাদের অনেকে প্রাপ্য পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে গমন করেছেন। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জনাব প্রিয়জ্যেতি খীসা (পরিচিতি নং-৫৩৯৩) বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮৬ ব্যাচের চৌকস কর্মকর্তা। তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে সর্বশেষ যুগ্মসচিব পদে তার কর্মজীবন সমাপ্ত করেছেন। তার নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তারা বিগত ২৭ নভেম্বর ২০১৬ তারিখের ৮৪২ নং প্রজ্ঞাপনে যুগ্মসচিব হতে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি কর্মকালীন সময়ে তার উপর অর্পিত সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সুচারুরুপে সম্পাদন করে দেশের মানুষের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, অত্যন্ত সৎ, দক্ষ, বিনয়ী, মেধাবী, অভিজ্ঞ ও শারীরীকভাবে সক্ষম একজন কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও জনাব প্রিয়জ্যেতি খীসা (পরিচিতি নং-৫৩৯৩) পদোন্নতি বঞ্চনার মানসিক যন্ত্রনা নিয়ে অবসর যাপন করছেন।
এমতাবস্থায়, জনাব প্রিয়জ্যেতি খীসাকে ভূতাপেক্ষাভাবে তার নিয়মিত ব্যাচের সাথে পদোন্নতি জারির বিধিগত সুযোগ পর্যালোচনার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
যদিও ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯’-এর ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী তাহার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব খাটাইতে বা খাটাইবার চেষ্টা করিতে পারিবেন না।’
একই আইনে তদবির করার জন্য সংসদ সদস্যদের কাছে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আইনটির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যাপারে তাহার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুরোধ জানাইতে পারিবেন না।’
১৯৫৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা এক স্মারকেও কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের কাছে তদবির করতে পারবেন না বলে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
এবিষয়ে জানতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ড. মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ সোনালীনিউজকে বলেন, কোনো সরকারি কর্মচারীর পদোন্নতির পক্ষে তদবির করা সম্পূর্ণ বে-আইনি। আইনে এধরণের তদবিরের কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যদি কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে হয় সে জন্য সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) রয়েছে। বোর্ডের সদস্যরা মতামত দিতে পারেন। কারো পদোন্নতির জন্য সরকারের মন্ত্রী বা উপদেষ্টাদের সরাসরি সুপারিশের সুযোগ নেই।
এসআই/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :