ঘরে ফিরছে মানুষ, চলছে ত্রাণ কার্যক্রম, পানি নেমে গেলে পুনর্বাসন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৪, ১০:১৩ এএম
ঘরে ফিরছে মানুষ, চলছে ত্রাণ কার্যক্রম, পানি নেমে গেলে পুনর্বাসন

ঢাকা : দেশে ডুবে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলের পানি কমতে শুরু করেছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছে। যদিও তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। এরইমধ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ জনে। এদের মধ্যে বেশি হতাহতের সংখ্যা ফেনীতে। বন্যার্তদের পাশে সরকারের পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে বেসরকারি ও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন তথ্যবিবরণী তুলে ধরছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রামে অন্তর্বর্তী সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে গেছে।

জানা গেছে, পানি নামলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও শুরু হবে। খবর বাসসের।

শনিবার (৩১ আগস্ট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ‘চলমান বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি’ নিয়ে প্রকাশিত তথ্য বিবরণীতে জানিয়েছে, বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে বলেও জানিয়েছে দুদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ১১ জেলায় আকস্মিক বন্যায় সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।

ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সূম্পর্ণ স্বাভাবিক ও কয়েক জেলায় উন্নতি হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। এখনও বন্যা কবলিত ১১ জেলার ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, এখনও দেশের ৬৮টি উপজেলা বন্যা প্লাবিত রয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন বা পৌরসভা রয়েছে ৫০৪টি। বর্তমানে পানিবন্দি ছয় লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি। বর্তমানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন।

বন্যায় ৫৯ জনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়েছে, মৃত ৫৯ জনের জনের মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ছয় জন ও শিশু ১২টি। এদের মধ্যে কুমিল্লায় মারা গেছেন ১৪ জন, ফেনীতে ২৩ জন, চট্টগ্রামে ছয় জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় একজন, লক্ষীপুরে একজন ও কক্সবাজারে তিনজন এবং মৌলভীবাজারে একজন। এছাড়া মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে।

তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, বন্যায় পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন লোক এবং ৩৬ হাজার ১৩৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

বন্যা কবলিত ১১টি জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৫১৯টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে জানিয়ে বিবরণীতে বলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৪ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা এবং ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।  এছাড়াও ৩৫ লাখ টাকা শিশু খাদ্যের জন্য ও ৩৫ লাখ টাকা গো-খাদ্যের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এতে আরও জানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কর্তৃক সংগৃহীত মোট এক লাখ ৪০ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, কাপড় ও পানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (ডিডিএম) মাধ্যমে বন্যা কবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। ডিডিএম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

বন্যা আক্রান্ত জেলাসমূহের প্রশাসকদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক বন্যা দুর্গত এলাকায় দুই লাখ, ৩৬ হাজার ৩২৮ প্যাকেট ত্রাণ ও ২০ হাজার ৪১০ প্যাকেট রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। মোট ৪২ হাজার ৮১৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে ও ২৩ হাজার ৫৭০ জনকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়াও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ১৫৩ জনকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত মোট ২৪টি ক্যাম্প ও ১৮টি মেডিক্যাল টিম বন্যা উপদ্রুত এলাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। এছাড়া খাবার পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, কাপড়, ওষুধ, বেবি ফুড ও স্যানিটারী আইটেম ইত্যাদি বিতরণ করা হয়েছে।

সার্বিকভাবে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছেন। বন্যা দুর্গত জেলাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে বলেও তথ্যবিবরণীতে জানানো হয়েছে।

এছাড়ও বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক চালু রয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে।

ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চলছে, পানি নামলে পুনর্বাসন : চট্টগ্রামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক বলেছেন, চলমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ত্রাণ ও বন্যার্তদের উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। পানি নেমে গেলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেব। উপদেষ্টা সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আজ শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মিলনায়তনে আয়োজিত মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

ফেনী, নোয়াখালীসহ বন্যা-কবলিত এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘আমি এখনও বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে পানিবন্দী থাকতে দেখেছি। সেখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শুকনো এবং রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। দুর্গম ও পানিবন্দী হওয়ায় ফেনী, নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া এবং উদ্ধার তৎপরতা চালাতে কিছুটা সময় লেগেছে। এসব এলাকায় নৌকায় চলাচলের সংস্কৃতি না থাকায় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকা এনে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বানভাসীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা আধুনিক বোটের সাহায্যে বন্যা-দুর্গতদের কাছে গিয়েছে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত এ উদ্যোগে আমরা অভিভূত। এটা আমাদের শক্তি জুগিয়েছে।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বন্যা এবং বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি জানার জন্য মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তাদের কাছে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলাম। তাদের কাছ থেকে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা বাস্তব চিত্র পেলাম। এর ভিত্তিতে আগামী দিনের পুনর্বাসন কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারবে সরকার।’

তিনি বলেন, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ। আমরা অগ্রাধিকার ঠিক করব। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও কমিটি হবে। আর এতে দেশে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করা হবে। সরকারের পুনর্বাসনের উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সব মানুষ যেন অবগত হতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হবে। বন্যা-দুর্গত এলাকার জনস্বাস্থ্যের দিকেও সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে। এসব এলাকায় পানিবাহিত নানা রকম রোগ হচ্ছে। সেগুলো আমরা চিহ্নিত করে মানুষের রোগমুক্তিতে কাজ করছি। প্রতিটি করণীয় ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে।’

ব্রিফিংয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ, দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক বন্যা-কবলিত চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন পরিদর্শন করেন।

হাটহাজারীর হালদা পাড় এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের বসতঘর নির্মাণ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা বন্যায় বসতঘর হারিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আপনারা চিন্তা করবেন না, সরকার আপনাদের পাশে আছে।’  

তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন। বন্যায়  মানুষের দুর্ভোগের কথা শোনেন এবং সরকার প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে বলে উল্লেখ করেন।

পরিদর্শনের সময় বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমেদ, হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোয়েব আহমদ, চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ, রাঙামাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান, সহকারী কমিশনার ভূমি মেহনাজ শারবীন প্রমুখ উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন।

নোয়াখালীতে পানি কমছে, ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত : জেলায় শুক্রবার ও আজ শনিবার কোনো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যার পানি এক সেমি পানি কমেছে। জেলার খালগুলো তুলনামূলকভাবে সরু হওয়ায়  অত্যন্ত ধীর গতিতে পানি কমছে।

অন্যদিকে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যহত আছে। জেলায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আমীর ফয়সল জানান, আগামি সাত দিন এ অবস্থা বিরাজমান থাকলে পরিস্থিতর দ্রুত উন্নতি হবে।

নোয়াখালীল জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, পানি কমতে শুরু করায় কিছু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজ বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। জেলায় একহাজার ২৬৯ টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু আছে। পানীয় জলের কিছুটা সংকট দেখা দেওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এবং আশেপাশের লোকজনের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট  বিতরণ করা হচ্ছে।

তিনি জানান, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারিভাবে একশ’ ২৪টি ও বেসরকারিভাবে ১৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

এ সময় পানিবাহিত রোগ ছড়াচ্ছে। সে কারণে খাবার স্যালাইন বিতরণ অব্যহত রয়েছে। জেলায় ত্রাণের কোনো সংকট নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এমটিআই

Link copied!