চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেও বৈষম্য

নিয়োগ পাওয়া ৮ সচিবের ৭ জনই ৮২ ব্যাচের

  • নিজস্ব প্রতিবেদক:  | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৪, ০৮:১২ পিএম
নিয়োগ পাওয়া ৮ সচিবের ৭ জনই ৮২ ব্যাচের

ঢাকা: ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে। এই ৮ জনের মধ্যে ৭ জনই রয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। 

সাত সিনিয়র সচিব হলেন- প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া, মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। এছাড়া বিসিএস ৮৩ ব্যাচের চুক্তিভিত্তিক সিনিয়র সচিব হলেন এ.এস.এম সালেহ আহমেদ।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সদ্য নিয়োগ পাওয়া চুক্তিভিত্তিক ৮ সিনিয়র সচিবের মধ্যে ৭ জনই বিসিএস ৮২ ব্যাচের হলেও ৮২ স্পেশাল ব্যাচের কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও বিসিএস ৮২ স্পেশাল ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩৩ জন সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সিনিয়র সচিব নিয়োগ পেয়েছিলেন ৫ জন কর্মকর্তা। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং প্রধান তথ্য কমিশনারের মত গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এই ৮২ স্পেশাল ব্যাচের কর্মকর্তারা।

বিসিএস ৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কেউ সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি। যদিও আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়ে এই ব্যাচের প্রায় ৬০ জন কর্মকর্তাকের উপসচিব এবং প্রায় ১৮৪ জন কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব পদ থেকেই পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে চাকরি থেকে অবসরে যেতে হয়। এই ব্যাচে ৪৮ জনের অধিক কর্মকর্তা সচিব এবং ১০ জনের অধিক কর্মকর্তা সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। একইভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন ৮৪, ৮৬, ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১৩তম ও ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। 

আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়ে পদোন্নতি ছাড়াই চাকরি জীবন শেষ করলেও এখনো পদোন্নতি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদের সিনিয়র সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর একান্ত সচিব মো. শফিউল্লাহ একই সময়ে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আসা অর্ন্তবর্তী সরকারের শপথের পর এর মধ্যে ৪জনকে চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলেও মো. শফিউল্লাহকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ এই কর্মকর্তা ব্যাচের মধ্যে একজন মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত যুগ্মসচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া তিনজন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও বেশ কিছু কর্মকর্তরা রয়েছেন যারা আওয়ামী শাসনামলে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্যে তথাকথিত উত্তরা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে দীর্ঘদিন ওএসডি থেকে অবসরে যাওয়া, গ্রেপ্তার, ওএসডি থাকাকালিন সচিবালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ, উচ্চতর গবেষণা কাজে নিযুক্ত থাকাকালে অনুমতি বাতিল করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এসব নির্যাতিত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন, ৮২ বিশেষ ব্যাচের যুগ্মসচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া ড. আব্দুস সবুর, আব্দুল বারি, উপসচিব হিসেবে অবসরে যাওয়া ৮৪ ব্যাচের ড. নেয়ামতুল্লাহ ভূইয়া, ৮৬ ব্যাচের আব্দুল মতিন, জাকির কামাল।

২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ এবং সহকারী একান্ত সচিব ড. সুরাতুজ্জামান প্রায় এক দশক ওএসডি থেকে অবসরে যান। ইতোমধ্যে একান্ত সচিব এএসএম সালেহ আহমেদকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ দিলেও সহকারী একান্ত সচিব ড. সুরাতুজ্জামান এখনো কোনো প্রমোশন পাননি। বিএনপি নেতা সালাউদ্দদিন কাদের চৌধূরীর একান্ত সচিব ড. এম মাহফুজুল হককে পর্তুগালে রাষ্ট্রদুত পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূইয়ার একান্ত সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়াকে প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিপন্থী বঞ্চিত কর্মকর্তা এবং তথাকথিত উত্তরা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে দীর্ঘদিন ওএসডি থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মোহা: মুজাহিদ এর একান্ত সচিব ড. আব্দুস সবুরকে পদোন্নতি বা পদায়ন করা হয়নি।

বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পর গঠন হওয়া সরকারে এখনো বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। পদোন্নতি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটছে। সরকারের থাকা একজন উপদেষ্টার সাথে যারা কাজ করেছেন অথবা তার সাথে আঞ্চলিক যোগাযোগ রয়েছে তাদেরকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যা নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পিডিএস পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে। ১/১১ এর তার সহযোগী এবং ঐ সময়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদেরকেই তিনি মূল্যায়ন করছেন। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জনপ্রশাসনে নতুন নিয়োগ পাওয়া মোখলেসুর রহমান ১৯৮৪ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেজারত ডেপুটি কালেকটর পদে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা পরিষদের সচিব, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করার পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভোলা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ইউরোপীয় কমিশন প্রকল্প, বিপিএটিসির পরিচালক পদে কাজ করার পর ২০০১ সালে বিএনপির শাসনামলে তিনি মৌলভিবাজার জেলা প্রশাসক হিসেবে আড়াই বছর দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর ২০০৬ সালে তিনি চট্রগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং ১/১১ এর সময় তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

এর আগে গত ১৭ আগস্ট সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. এসকে আব্দুর রশিদ এর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯২ সালে বিএনপির শাসনামলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৭ সালে বিপিএটিসিসি, সচিবের একান্ত সচিব, সিনিয়র সহাকারী সচিব পদে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক, ওয়াকফ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১/১১ এর পর ২০০৯ এর জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলী করা হয়।

সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৮৩ সালের নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর সহকারী কমিশনার, উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, থানা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র সহকারী সচিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের পর বিএনপির শাসনামলে তিনি  জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব, ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১/১১ এর সময়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এসআই/আইএ

Link copied!