চট্টগ্রাম : মামলা জটিলতায় নষ্ট হচ্ছে শতকোটি টাকার ২৯৭টি গাড়ি। বন্দর ইয়ার্ডের মূল্যবান জায়গা দখল করে এসব গাড়ি পড়ে থাকায় বন্দরের যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি এসব গাড়ি ব্যবহার না হওয়ায় দেশ হারাচ্ছে রাজস্ব। নিয়ম অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি আসার ৩০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নেওয়া না হলে নিলামে বিক্রি করা যাবে। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, গাড়িগুলোর বিপরীতে মামলা থাকায় তারা অসহায়।
জানা যায়, আমদানি করা গাড়ির সঙ্গে ডকুমেন্টের মিল না থাকা, যে সিসির গাড়ির আনার কথা, তার চেয়ে বেশি সিসির গাড়ি আনা, বিভিন্ন কারণে কাস্টমস থেকে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া গাড়িগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে পড়ে রয়েছে।
সম্প্রতি বন্দরের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ইয়ার্ডের সাধারণ লেভেল থেকে একটু নিচু এলাকায় গাড়িগুলো রাখা হয়েছে। খালি চোখে ওপরের দিকে শুধু গাছগাছালি দেখা যায়। গাড়িগুলো স্পষ্ট দেখা যায় না। এ ছাড়া বর্তমানে বন্দরের ইয়ার্ডের বাইরে কারশেড এবং ইয়ার্ডের ভেতরে একটি আধুনিক কারশেড করলেও এই ডাম্পিংয়ে এখন আর গাড়ি রাখা হয় না।
এসব গাড়ির বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দরের ভেতরে ডাম্পিং অবস্থায় থাকা ২৯৭টি গাড়ির মধ্যে ২০০২ সালের গাড়িও রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এসব গাড়িকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কাস্টমসকে দফায় দফায় অনুরোধ করলেও নেয়নি। এই গাড়িগুলো বন্দরের মূল্যবান জায়গা দখল করে রেখেছে।’
কাস্টমস আইন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি আসার ৩০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি নেওয়া না হলে নিলামে বিক্রি করা যাবে। সর্বশেষ বিগত সরকারের ২৪ এমপির গাড়ি বন্দরে আসার ৩০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি না নেওয়ায় গাড়িগুলোর তালিকা কাস্টমসের কাছে পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই তালিকা অনুযায়ী নিলাম ডাকার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে কাস্টমস।
আমদানিকারকের বিপরীতে শেষবারের মতো চিঠিও ইস্যু করেছে যে, শুল্ক দিয়ে এসব গাড়ি ডেলিভারি নেওয়ার জন্য। যদি ডেলিভারি নেওয়া না হয় তাহলে এগুলো নিলামে বিক্রি করা হবে। এমপিদের গাড়ি যদি নির্ধারিত সময়ের পর নিলামে ওঠানো যেতে পারে, তাহলে বছরের পর বছর বন্দরের ভেতরে থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়িগুলো কেন নিলামে ওঠানো হচ্ছে না?
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপ-কমিশনার (নিলাম) সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এসব গাড়ির বিপরীতে মামলা রয়েছে। আর মামলা থাকলে আমরা নিলামে তুলতে পারি না।’
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ আইনের বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানিয়েছেন কাস্টমস থেকে বিড করে পণ্য সংগ্রহকারীদের সংগঠন কাস্টমস বিডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মামলার একটি নির্ধারিত সময় থাকে। একটি মামলা আজীবন চলতে পারে না। গাড়ির মামলাগুলো ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা। আর যদি আদালত রায় নাও দেয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাতিল হয়ে যায়। সেই আলোকে কাস্টমস তা নিলামে ওঠাতে পারে। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তারা আইনের দোহাই দিয়ে গাড়িগুলো রেখে দিয়ে নষ্ট করে ফেলে। পরে আর এগুলো ব্যবহারও করা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি এমন ৭৫টি গাড়ি নিলামে বিক্রি না করে টুকরো টুকরো করে রাখা হয়েছে। এগুলো টুকরো না করে নিলামে দিলে আমরা গাড়ির পার্টসগুলো অন্ততপক্ষে কাজে লাগাতে পারতাম।’
চট্টগ্রাম বন্দরের ডাম্পিং শেডে থাকা ২৯৭টি গাড়ি কী কী মামলায় আটকা থাকতে পারে জানতে চাইলে কাস্টমস কর্মকর্তা, গাড়ি আমদানিকারক ও বিডাররা জানান, আমদানি করা গাড়ির সঙ্গে ডকুমেন্টের মিল না থাকা এবং যে সিসির গাড়ির আনার কথা ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে এর চেয়ে বেশি সিসির গাড়ি আনা।
এ ছাড়া পাঁচ বছরের পুরনো গাড়ি (উৎপাদনের তারিখ থেকে বন্দরে আসার তারিখ পর্যন্ত) আনা হলে, কারনেট সুবিধায় (পর্যটক সুবিধায়) আসা গাড়িসহ বিভিন্ন কারণে কাস্টমস থেকে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া গাড়িগুলোই চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে পড়ে রয়েছে।
খোলা আকাশের নিচে বছরের পর বছর পড়ে থেকে গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পুরনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কাস্টমসের নিলাম নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এসব গাড়ি নষ্ট হয়েছে। কাস্টমস চাইলে এসব গাড়ি নিলামে বিক্রি করতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে একাধারে বন্দরের যেমন ক্ষতি করেছে তেমনিভাবে দেশের আর্থিকও ক্ষতি করেছে। এসব গাড়ি ডলারে কেনা হয়েছে। আবার গাড়িগুলো ব্যবহার না হওয়ায় এগুলোর সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম।’
তাহলে তো এসব গাড়ি নিলামেও বিক্রি করা যাবে না এমন প্রশ্নের জবাবে কাস্টমসের উপ-কমিশনার (নিলাম) সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘মামলা ছাড়া যেসব গাড়ি রয়েছে সেগুলো আমরা নিলাম প্রক্রিয়ায় আনার উদ্যোগ নিয়েছি। তবে যদি মামলা থাকে তাহলে সম্ভব হবে না।’
কিন্তু আমদানিকারকরা বলছিল, ৩০ বা ৪৫ দিনের পর আর মামলা থাকে না। এমন প্রশ্নের জবাবে সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানিকারকদের বক্তব্য সঠিক নয়। যদি কোনো গাড়ির নামে মামলা থাকে তাহলে আদালতের অনুমোদন ছাড়া এসব গাড়ি নিলামে বিক্রি করা যাবে না। আর এজন্যই হয়তো এসব গাড়ি বছরের পর বছর পড়ে রয়েছে।’
তাহলে এসব গাড়ির ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা কিছু গাড়ি আদালতের অনুমোদনে স্ক্র্যাপ করেছি। এখন সেসব লোহার টুকরো বিক্রির চেষ্টা করছি। এসব গাড়িও একই প্রক্রিয়ায় নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :