ঢাকা : নতুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. জয়শঙ্করের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এবং বৈঠকে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ নিয়ে আবারও ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোতে আলোচনা চলছে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, ওয়াশিংটন কি দিল্লির চোখেই ঢাকাকে দেখবে? নাকি বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে হাঁটবে?
আবার ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিবাসন নীতিতে হাত দিয়েছেন এবং দেশটিতে অবৈধভাবে বসবাস করছেন এমন প্রবাসীদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে। গত তিন দিনে পাঁচ শতাধিক অভিবাসী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে চার বাংলাদেশিও রয়েছেন। দেশটিতে এখন গ্রেপ্তার আতঙ্ক চলছে।
এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, ট্রাম্পের এই অভিবাসী নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ভারতীয়দের। ভারতীয় গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ লাখের মতো ভারতীয় নাগরিক বসবাস করছেন, যাদের সঠিক কাগজপত্র নেই।
একদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে গত কয়েক মাস ধরে বলা হচ্ছে, ট্রাম্প-মোদির বন্ধুত্বের কথা। আর বিপরীতে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিতে ভারতীয়দের কীভাবে রক্ষা করবেন বন্ধু দাবিদার মোদি। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতাদের মধ্যে মোদির আমন্ত্রণ না পাওয়াও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
তবে ট্রাম্পের শপথে জয়শঙ্করের উপস্থিতি এবং এরপরই কোয়াডভুক্ত চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ও এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে অন্য ধরনের আলোচনার সূত্রপাত হয়।
বিশেষ করে, জয়শঙ্করের ও মার্কো রুবিওর বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে খবর প্রকাশে নড়েচড়ে বসে ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো।
বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ভারতীয় দূতাবাসে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জয়শঙ্কর বলেছেন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তাদের মধ্যে ঠিক কী কথা হয়েছে তা বলেনি নয়া দিল্লি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় কোনো বৈঠকে জয়শঙ্করের সঙ্গে মিলিত হন রুবিও।
বৈঠকে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির ওপর জোর দেন মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে সংবাদ সম্মেলনের ভিডিওটি পোস্ট করেছেন জয়শঙ্কর নিজেই, যা পরবর্তী সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রচার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে রুবিওর সঙ্গে জয়শঙ্করের মধ্যকার বৈঠকের নানা বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। এ ছাড়া জয়শঙ্কর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তবে এ বৈঠকের ঢাকার বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে, তা পরিষ্কার না করায় এ নিয়ে নেতিবাচক ও ইতিবাচক আলোচনা হয়। দুই দেশের কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা হয়, বাংলাদেশ ইস্যুতে মধ্যস্থতার জন্য হয়তো ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায়। আবার আলোচনা হয়, ঢাকার বিষয় এবং এ অঞ্চলের নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ওয়াশিংটন-দিল্লি এক হয়ে কাজ করতে চায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা চীন সফরে গিয়েছেন। সেই সফরের দিকে নজর রাখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকা যেন কোনোভাবেই বেইজিংয়ের দিকে বেশি হেলে না পড়ে সেদিকে দুই দেশেরই নজর। একদিকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বাইডেন সরকারের বন্ধুত্ব এবং তাকে সমর্থন দেওয়া। আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সম্পর্ক— ফলে ওয়াশিংটন এবং দিল্লি এ নিয়ে খুবই সতর্ক অবস্থানে।
কূটনীতিকরা মনে করেন, ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন এই বিশ্বমোড়লদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ট্রাম্পের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমেই বৈঠকে ঢাকার বিষয়টি আলোচনায় এনেছেন। তারা মনে করেন, ঢাকা বিষয়ে ওয়াশিংটন ও দিল্লির কৌশল কয়েক দিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে।
এর মধ্যে শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) এসব আলোচনা-সমালোচনার মুখে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, দুই দেশের জনগণের যাতে ভালো হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে এমন সম্পর্ক রাখতে চায় ভারত। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বতন্ত্র, যা অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে না।
সাপ্তাহিক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর জয়সওয়াল আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। আমরা গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের পাশে থাকতে চাই। আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এমনভাবে উন্নীত করতে চাই যেন দুই দেশের জনগণের ভালো হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ‘স্বতন্ত্র’এবং তার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক কেমন হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে না।’
জয়সওয়াল বলেন, ‘আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত এ অঞ্চলের সব ঘটনার ওপর আমরা নিবিড়ভাবে খেয়াল রাখছি। আমরা সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করি এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে গতিবিধি চলছে, বিশেষ করে যা ভারতে প্রভাব ফেলতে পারে, সেসব ইস্যু ভারত সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত কোনো গতিবিধি হলে তাতেও ভারত কড়া নজর রাখে।’
সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে উল্লেখ করে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘বিভিন্ন অপরাধ বন্ধ করার জন্য সীমান্তে বেড়া দেওয়া জরুরি। আমরা মনে করি সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন পর্যন্ত যতগুলো সমঝোতা হয়েছে, বাংলাদেশ এগুলো ইতিবাচকভাবে নিয়ে কার্যকর করবে। মানব পাচার, গরু পাচারসহ যেসব অপরাধ হয়, তা বন্ধ করে অপরাধমুক্ত একটা সীমান্তে রূপ দিতে হবে।’
সীমান্তে বেড়া দেওয়া ইস্যুতে যে গতিবিধি চলছে, তা দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ীই হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন রণধীর জয়সওয়াল।
আগামী মাসে নয়াদিল্লিতে বিএসএফ-বিজিবি মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকের বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘প্রস্তাবিত বৈঠক নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে এর তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।’ এদিকে শুক্রবারও সীমান্তে পাল্টাপাল্টি উত্তেজনার ঘটনা ঘটেছে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। আর একই সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গত ৫৩ বছরের তুলনায় একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে। দুপক্ষ থেকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগের কথা বলা হলেও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া, শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানোর বিষয়সহ নানা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিরোধপূর্ণ বক্তব্য বন্ধ হয়নি।
মার্কো রুবিও ও এস জয়শঙ্কর : মার্কো রুবিও ও জয়শঙ্করের বৈঠকে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির ওপর জোর দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ভারতীয় দূতাবাসে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান জয়শঙ্কর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে সংবাদ সম্মেলনের ভিডিওটি পোস্ট করেছেন জয়শঙ্কর নিজেই। যা পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রচার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে রুবিওর সঙ্গে জয়শঙ্করের মধ্যকার বৈঠকের নানা বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
সেখানে এক সাংবাদিক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কী কথা হয়েছে তা জানতে চাইলে জয়শঙ্কর বলেন, ‘হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। তবে কী কথা হয়েছে এখনই প্রকাশ করা সমীচীন হবে না।’
এই বৈঠক সম্পর্কে ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেকের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন ডিসিতে দেশটির নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে গঠিত চার দেশীয় জোট কোয়াডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। এসব বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারত।
এ ছাড়া মঙ্গলবার মার্কো রুবিওর সঙ্গে জয়শঙ্করের বৈঠকের বিষয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে অংশীদারত্ব জোরদার করার অভিন্ন প্রতিশ্রুতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, মার্কো রুবিও ও এস জয়শঙ্কর বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক আরও গভীর করার বিভিন্ন সুযোগ, গুরুত্বপূর্ণ ও বিকাশমান প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা সহায়তা, জ্বালানি এবং একটি স্বাধীন ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুজনের কথা হয়েছে।
এ ছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতের সঙ্গে কাজ করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আকাঙ্ক্ষার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়েছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ‘অনিয়মিত অভিবাসন’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :