ঢাকা: সংস্কার শুধু সরকারের ইচ্ছার বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। তাই সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক সনদ প্রণয়ন করতে হলে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ।
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর উদ্যোগে ‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান প্রমুখ। লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
ড. আলী রিয়াজ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি ওঠার কারণ হলো, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও ভঙ্গুর করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৫৪ বছরে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা দেখেছি, বিগত ১৫ বছরে বিচার বিভাগকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন না হলে, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে পুনগর্ঠিত করা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হলেও ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। তাই বাংলাদেশে ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্রের পুনরুত্থান ঠেকাতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেখ হাসিনা দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ব্যবস্থায় পৌঁছাতে তার ১৫ বছর লেগেছে। তিনি নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কারণে শেখ হাসিনার পলায়নের পর আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে, যাতে একটি ‘নাগরিক সনদ’ তৈরি করা যায়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের তিনটি ম্যান্ডেট। একটি হলো, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যাতে আবার ফিরে আসতে না পারে সেজন্য কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা; দ্বিতীয়ত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা; তৃতীয়ত একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা। এগুলো একইসঙ্গে হতে পারে, কোনোটি অপরের সঙ্গে সংঘর্ষিক নয়।
বিচারপতি এমদাদুল হক বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে অতীতে বিভিন্ন প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ তুলে ধরেছে। আমি মনে করি, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন সময় এসেছে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের।
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে সুফিবাদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। কিন্তু তারপর সংস্কার কমিশনের জরিপে ৮৫ শতাংশ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়ে শুরু হওয়া ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিচিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক সমস্যা থাকলেও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার ও দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই যৌক্তিক কতগুলো সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, অতীতে সংস্কার একটি গালিতে পরিণত হলেও সংস্কার এখন বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমি মনে করি, সংস্কারের পূর্বে আমাদের রাষ্ট্র ভাবনা কেমন হবে, তা পরিষ্কার করা উচিত। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশে কখনই রাষ্ট্র ভাবনা ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে সুচিন্তিত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রবর্তনের অল্প কিছু কাল পরেই এতে নানান সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে সংবিধানে অনেকগুলো সংশোধনী আনতে হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ সংশোধনী আনা হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থে।
বিগত ১৬ বছরের অভিজ্ঞতার ফলে সংস্কার একটি অনিবার্য বাস্তবতা এবং এক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ড তৈরি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধ পাঠকালে দিলীপ কুমার সরকার ৫টি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিশ্বাস জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোসহ সকল অংশীজনের সঙ্গে বসে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে পারবে এবং সেই ঐকমত্যের সূত্র ধরেই আমরা সংস্কার প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করব। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা; ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক সরকারের উদ্যোগে যে সকল সংস্কার প্রস্তাব কার্যকর করা হবে তা বিভাজিত করা; জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ প্রস্তুত করা; একটি জাতীয় সংলাপ আয়োজন করে জাতীয় সনদে সকল রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের স্বাক্ষর গ্রহণের মধ্য দিয়ে সংস্কারের বিষয়ে তাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ করা; অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নির্ধারিত সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি করা; একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা; বিজয়ী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং নবগঠিত সরকারের নেতৃত্বে জাতীয় সনদে উল্লিখিত সংস্কার প্রস্তাগুলো বাস্তবায়নের করা এবং পরবর্তীতেও তা চলমান রাখার প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় সনদে এই মর্মে উল্লেখ থাকবে, ‘যে রাজনৈতিক দল বা জোটই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করুক না কেন, সেই দল বা জোট জাতীয় সনদে বর্ণিত সংস্কার প্রক্রিয়া আবশ্যিকভাবে সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং যে সকল দল বা জোট বিরোধী দলের আসনে বসবে, তারা আবশ্যিকভাবে তা সমর্থন করবে। জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক দলসহ সকলের জন্য অবশ্য পালনীয় একটি আচরণবিধি প্রণীত হবে। সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নসহ আচরণবিধি সংশ্লিষ্ট সকলে যথাযথভাবে মেনে চলছেন কি না, তা দেখার জন্য রাজনৈতিক দলসহ সকল অংশীজনের সমন্বয়ে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠিত হবে। পাশাপাশি জাতীয় সনদের বিষয়গুলোকে সংবিধানে সন্নিবেশনের জন্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে একটি বিল আনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটি বিকল্প ধারণা হতে পারে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে উচ্চ আদালতের পরামর্শ (গাইডেন্স) সাপেক্ষে একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জাতীয় সনদে বর্ণিত বিষয়সমূহকে সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। ’
আইএ
আপনার মতামত লিখুন :