বিনিয়োগ সম্মেলন

দুর্নীতিসহ ৫ সমস্যা বিদেশিদের

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম
দুর্নীতিসহ ৫ সমস্যা বিদেশিদের

ঢাকা : দেশে চলছে বিনিয়োগ সম্মেলন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে চলছে এ আয়োজন। তবে আয়োজন কেবল হোটেলে সীমাবদ্ধ নয়। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের পরিবেশ প্রত্যক্ষ করতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করছেন। দেখা করছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও। আর যারা সন্তুষ্ট হচ্ছেন তারা বিনিয়োগের জন্য চুক্তিও করছেন।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বিনিয়োগকারীদের একটি দল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার পরিদর্শন করে। এদিন কোরীয় বিনিয়োগকারীদের একটি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এছাড়া এদিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং সুইডেনের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

এদিন সংবাদ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, দ্বিতীয় দিনে সকাল থেকে দুটি বড় বিনিয়োগকারী দলের সঙ্গে মিটিং হয়েছে।  বিনিয়োগকারীরা এ সময় তাদের নানা সমস্যার কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে চীনের একটি নির্মাণ খাতের বড় গ্রুপ বিনিয়োগ করতে চায়। তারা তাদের সমস্যার কথাও জানিয়েছে।

তিনি বলেন, চীনের এ বিনিয়োগকারীরা বলেছেন, তোমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের বড় বড় কথা শুনতে ভালো লাগে, তোমাদের নীতিও ভালো। কিন্তু তোমাদের মাঠ পর্যায়ে গেলে আমরা অনেক জটিলতা দেখতে পাই।

হংকংয়ের এক বিনিয়োগকারী সাড়ে তিন বছর ঘুরেও লাইসেন্স পাননি এমন তথ্য তুলে ধরে চৌধুরী আশিক বলেন, চীনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হংকংভিত্তিক এক নারী বিনিয়োগকারী সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য ঘুরেও লাইসেন্স পাননি। ওই বিনিয়োগ না পাওয়ায় বাংলাদেশের ২০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। আর ওই বিনিয়োগকারী জানিয়েছেন, সুযোগ পেলে তিনি ১০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারতেন।

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, ঋণ পেতে জটিলতা, বিদ্যুতের সমস্যা, দুর্নীতিসহ মোট ৫টি কারণে ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতায় ভোগেন। যেসব কারণে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় ঘুরেও বিনিয়োগ করতে পারেনি বলে জানা গেছে। বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আয়োজনে বাংলাদেশ কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়গনস্টিক শিরোনামের সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

সেমিনারে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন জানিয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় পাঁচটি সমস্যা রয়েছে। জরিপের তথ্য উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, ব্যবসায়ীদের ২১ শতাংশ বিদ্যুতের সমস্যা, ১৭ দশমিক ২ শতাংশ ঋণ পেতে জটিলতা, ১৩ শতাংশ দুর্নীতির কারণে, ৯ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসার কারণে এবং ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী করহারের কারণে ব্যবসা করতে পারছেন না।

সেমিনারে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসি জানিয়েছে, দেশের ব্যবসায় পাঁচ ধরনের বড় সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া, চীনের এক বিনিয়োগকারী জানিয়েছেন, সাড়ে তিন বছর ধরে ঘুরেও তিনি বাংলাদেশের বিনিয়োগ করতে পারেননি। ফলে বাংলাদেশ ২০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ হারিয়েছে।

ব্রিকসের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) দেশে আরও এক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করতে চায় উল্লেখ করে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, এনডিবি বিনিয়োগ সম্মেলনে জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। বেসরকারি খাতে তারা আরও এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। তবে সুদের হার অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি হবে বলে জানান বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।

এদিকে মঙ্গলবার দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের একটি দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে তাদের নানা প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন। ইয়ংওন করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সুং-এর  নেতৃত্বে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদলটি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে  বৈঠককালে এ ঘোষণা দেন।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে কোরিয়ান প্রতিনিধিদলে এলজির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি টেক্সটাইল, ফ্যাশন, স্পিনিং, লজিস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎসহ নানা খাতের কোম্পানির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত সোমবার, কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) পরিদর্শন করেন, যেখানে বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী ইয়ংওন করপোরেশনের মালিকানাধীন এবং পরিচালিত শিল্প পার্কে অবিলম্বে বিনিয়োগের জন্য প্রতিশ্রুতির কথা জানান।

বৈঠকের সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস শ্রম, শিল্প, জ্বালানি এবং বিনিয়োগ নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির লক্ষ্যে সংস্কারের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আনন্দিত যে আপনি এমন একটি সময়ে বাংলাদেশ সফর করছেন যখন আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ছি। এই নতুন বাংলাদেশে আমরা বিদেশি বিনিয়োগকে সহজ ও ঝামেলামুক্ত করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ হলো আপনার জন্য এটিকে মসৃণ করা। আমি জানি আপনি গত ১৬ বছরে কিছু কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছেন এবং আমরা হারিয়ে যাওয়া সময় পূরণ করতে চাই।’

ইয়ংওন করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সুং জানান, তার কোম্পানি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চট্টগ্রামে একটি টেক্সটাইল এবং ফ্যাশন কলেজ প্রতিষ্ঠা করবে, যাতে একটি ট্যালেন্টপুল তৈরি করা যায়। যা বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টেক্সটাইল হাবে রূপান্তর করতে সহায়তা করতে পারে।

তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক চিঠির প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, এটি নতুন আমেরিকান প্রশাসনের উদ্বেগের সমাধান করেছে। ‘এটি একটি সুলিখিত চিঠি ছিল’- সুং বলেছেন, তিনি গার্মেন্টস শিল্পকে সম্ভাব্য মার্কিন পদক্ষেপ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

কোরিয়ান প্রতিনিধিদল জানান, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর দ্রুত বর্ধনশীল এবং দেশটির বিকশিত বৈশ্বিক বাণিজ্য ল্যান্ডস্কেপে ওষুধের একটি নেতৃস্থানীয় রপ্তানিকারক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একজন বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে একটি এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট) প্ল্যান্ট স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। উপরন্তু, অধ্যাপক ইউনূস প্রতিনিধিদলের একজন শীর্ষ কোরিয়ান সার্জনকে চট্টগ্রামে একটি হাসপাতাল স্থাপনের পরামর্শ দেন।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) আর্টেমিস অ্যাকর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। মঙ্গলবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে-২০২৫ এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ৫৪তম দেশ হিসেবে নাসার সঙ্গে যুক্ত হলো।

এ সময় নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক জ্যানেট পেট্রো (ভার্চুয়ালি), ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান স্টিফেন ইবেলি ও অ্যাক্টিং ইকোনমিক ইউনিট চিফ জেমস-এস গারডিনার উপস্থিত ছিলেন।   

এছাড়া নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বিএসইজেড) সঙ্গে পোশাক খাতের বিভিন্ন উপকরণ তৈরির প্রতিষ্ঠান নিলর্ন বাংলাদেশ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বিএসইজেড-এ ধাপে ধাপে ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে, যেখানে ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।   

নিলর্ন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে নিলর্ন বাংলাদেশের একটি কারখানা আছে। এখন তারা বিএসইজেডে গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ উৎপাদনের জন্য আরও বড় পরিসরে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।

তিনি জানান, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হবে। সেই আশাতেই এই বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি। সরকার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে সেটাই আমরা চাই।

নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড) পরিদর্শনের সময় দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

এ সময় তারা বলেন, হঠাৎ নীতি পরিবর্তন হলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে বিনিয়োগকারীরা সব সময়ই উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ককর, গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো পরিষেবা নিয়েও বেগ পেতে হয় তাদের। এ সময় বিনিয়োগকারীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করার অনুরোধ জানান।

মঙ্গলবার চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ৩৬ বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বিএসইজেড বা জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে যান। প্রতিনিধিদলটি জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে পৌঁছালে বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ প্রথমেই তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা সম্পর্কে ধারণা দেয়। এরপর সেখানে অবস্থিত সিঙ্গারের কারখানা ঘুরে দেখেন তারা।

এ সময় বিএসইজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারো কাওয়াচি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে কী ধরনের আধুনিক কারখানা স্থাপন করা সম্ভব, তার ভালো উদাহরণ হতে পারে বিএসইজেডে স্থাপিত সিঙ্গারের কারখানা। মাত্র ২০ মাস সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করেছে সিঙ্গার। সে জন্য তারা বিনিয়োগ করেছে ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে এই কারখানায় প্রতিমাসে ৫০ হাজার পিস (ইউনিট) ফ্রিজ ও ১০ হাজার পিস (ইউনিট) টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে।

এমটিআই

Link copied!