বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনে ইউনূস শোনালেন গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোনের শুরুর গল্প

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৫, ০৫:০৮ পিএম
বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনে ইউনূস শোনালেন গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোনের শুরুর গল্প

ঢাকা : বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিবর্তনের আগ্রহ কারো থাকলে, তাদের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে সেই জায়গা।

তার ভাষায়, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে দুনিয়া পরিবর্তনের পাগলাটে ধারণাগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে।

বুধবার (৯ এপ্রিল) বিডা ইনভেস্টমেন্ট সামিটের তৃতীয় দিনে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতা করছিলেন সরকারপ্রধান। সেখানে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের তিনি শোনালেন নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক ও দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, টাকা উপার্জন করা সুখ, কিন্তু অন্যদের সুখী করা হল সুপার সুখ। যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, তাহলে আপনি দুটি সুখই পাবেন—সাধারণ সুখ এবং সুপার সুখ। এবং এটি আপনি অতিরিক্ত কিছু খরচ ছাড়াই পেয়ে যাবেন।

ইউনূসের বক্তৃতায় আসে ১৯৭৪ সালের ‘দুর্ভিক্ষের’ কথা। তিনি বলেন, ৭৪ সাল সেই বছর, যা আমরা ভুলতে পারব না। মানুষ ক্ষুধার কারণে মৃত্যবরণ করে। পুরো দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ বয়ে যায়। দেড় মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। ওটাই ছিল সেই দেশ, যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

আমরা এক ফসলই ফলাতাম। আর কোনো উপায় আমাদের জানা ছিল না। আমাদের জনসংখ্যা ছিল কৃষক হিসেবেই পরিচিত, কারণ তাদের আর কোনো পেশা ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল ভূমিহীন কৃষক। তাদের নিজের কোনো জমি ছিল না। যারা অল্প জমির মালিক ছিল, তাদের কাছ থেকে সামান্য জমি লিজ নিয়ে এক ফসল ফলিয়ে জীবিকা চলত। আপনি যদি 'চরম দারিদ্র্য' শব্দটা শুনে থাকেন—সেটাই ছিল বাংলাদেশ। জীবনটা ছিল খুব কঠিন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করি ১৯৭৪ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত—এটা এক অসাধারণ ভ্রমণ। এখানে আমরা সব বড় শিল্প নিয়ে কথা বলি। অনেক দেশকে আমন্ত্রণ জানাই আরও শিল্প স্থাপনের জন্য। আমরা একটি বিশাল বাজার নিয়ে কথা বলি।

এই বিশাল মেধাবী তরুণ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলি—বাংলাদেশ খুব অল্প সময়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

গ্রামীণ ব্যাংক শুরুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে একটি ছোট উদ্যোগ এসেছে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে। মানুষকে ২ বা ৩ ডলারের মত ছোট ঋণ দেওয়া হত, যেন তারা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে—বিশেষভাবে নারীদের ওপর গুরুত্ব দিয়ে। কারণ নারীরাই ছিল সবচেয়ে অসহায়। এই ধারণা 'মাইক্রো ক্রেডিট' নামে পরিচিত হয়। আমরা একটি ব্যাংক তৈরি করি, যার নাম গ্রামীণ ব্যাংক।

কেউ জানত না শেষ পর্যন্ত এটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু এটা হয়ে উঠল একটি বৈশ্বিক নাম। কারণ আপনি যেই দেশেই থাকুন না কেন, আপনার ভেতরে একটু হলেও ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে। আপনি তা হয়তো চিনতে পারেন না, কিংবা লুকিয়ে রাখেন। আপনি জনগণের টাকা তাদের (দরিদ্রদের) দিয়ে দেন, ভাবেন এটাই সমাধান। কিন্তু গরিব মানুষকে শুধু সরকারি টাকা দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। আসল সমাধান হল একটি কাঠামো তৈরি করা, এমন একটি ব্যবস্থা, যা মানুষের শক্তিকে মুক্ত করে দেয়। মাইক্রোক্রেডিট ছিল সেই উদ্যোগের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ।'

১৯৮৩ সালে সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২৮ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

গ্রামীণফোনের লাইসেন্স নেবার সময়ের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এক পাগলাটে চিন্তা এল—সরকার ফোন ব্যবহারের লাইসেন্স দেবে। তখন আমাদের কোনো ফোনই ছিল না, টেলিফোন বলতে দেশে কিছুই ছিল না।

শহরে হাতে গোনা কয়েকটা টেলিফোন ছিল, তার বেশিরভাগই কাজ করত না। তখন ভাবলাম, কেন আমরা একটা টেলিফোন কোম্পানির লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি না? একেবারে পাগলাটে একটা ভাবনা ছিল। সরকার জিজ্ঞাসা করল—এই টেলিফোন লাইসেন্স দিয়ে কী করবে? কী ব্যবসা করবে? আমি বললাম—আমি এটা গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দেব। ওরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করল।

আমরা শেষমেশ লাইসেন্স পেয়ে যাই। নাম দিই ‘গ্রামীণফোন’—কারণ আমাদের ছিল গ্রামীণ ব্যাংক, তাই গ্রামীণফোন। কেউ আমাদের সঙ্গে অংশীদার হতে চাইল না, কারণ আমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না, কিছুই জানতাম না। তখন সবাই বলত, বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের জন্য উপযুক্ত জায়গা না। এখানে মোবাইল ফোনের কোনো বাজারই নেই।'

শেষ পর্যন্ত নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি অংশীদার হতে রাজি হয়। সে কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি তাদের বোঝাই কেন আমরা এই ফোন নারীদের জন্য আনতে চাই। তারা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। তবে শুরুতে তাদের বোর্ড রাজি হয়নি, পরে তারা সম্মত হয়। এরপর তো এটি দেশের সর্ববৃহৎ টেলিফোন কোম্পানিতে রূপ নেয়।

১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণফোন। বর্তমানে দেশের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে গ্রামীণফোনের।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদানের’ স্বীকৃতিতে এই অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ইয়ংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া বিনিয়োগে বিশেষ অবদানের জন্য ‘এক্সিলেন্স ইন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয় চার কোম্পানিকে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ যারা পুরস্কৃত হয়েছেন, তাদের শক্তিশালী পাগলাটে ধারণাই তাদের সফল করেছে। তাই আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি সেই সৃষ্টি কাজে যোগ দিতে—শুধু বাংলাদেশকেই পরিবর্তন করবেন না, ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলান।

তিনি বলেন, আমি সবসময় মানুষকে মনে করিয়ে দিই, যদি আপনি লাভ চান, এগিয়ে যান, লাভ করুন, যতটুকু পারুন সর্বাধিক করুন। তবে আমরা তাতে একটু সামাজিক উদ্দেশ্যও যোগ করতে পারি। এটা লাভের পথে বাঁধা হবে না, বরং মজাদার কিছু হবে, যেমন অনেকেই ইতিমধ্যে করে থাকেন।

আপনি জানবেন না আপনার ব্যবসা কেমন হবে, কেন পুরো পৃথিবী আপনাকে অনুসরণ করছে, হঠাৎ করে পিছনে ফিরে তাকাবেন, কীভাবে এটা ঘটল—বাংলাদেশ এটা সম্ভব করেছে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে তা এ অঞ্চল জুড়ে ব্যবসা বিস্তৃত করার সুযোগ তৈরি করবে বলে বিনিয়োগকারীদের আশা দেখান প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, এটি একটি শক্তিশালী অঞ্চল, অনেক সম্পদ রয়েছে, আমরা একসাথে এটি সহজতর করতে পারি।

তিন শূন্যের ধারণা নিয়ে যে পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন ইউনূস দেখেন, তা কেবল সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার তা অর্জন করতে পারবে না, কারণ এটি সরকারের কাজ নয়। এটি একক ব্যক্তির কাজ। আমরা মনুষ্যজাতি, পৃথিবী বদলাতে পারি। ব্যবসা আমাদের হাতে একটি শক্তিশালী 'টুল' তুলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, এবং শূন্য বেকারত্ব, তরুণরা এতে খুব আগ্রহী হবে... আপনারা সবাই উদ্যোক্তা, চাকরি খোঁজার মানুষ নন, উদ্যোক্তাদের মত ভাবুন, জিনিসগুলো ঘটান এবং বাংলাদেশ হল সেই জায়গা।

দেশের পোশাক শিল্পের শুরুর দিকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৭০-এর দশকের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কিছু সাহসী তরুণ, যারা অন্যরকম কিছু করার সাহস দেখিয়েছিল। বিদেশি দেশগুলোর গার্মেন্ট শিল্প দেখে তারা বলেছিল, 'কেন আমাদের না?

এটি ছিল বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের সূচনা। সেই পাগল তরুণরা, তারা ছিল প্রথম প্রজন্ম, তাদের মধ্যে কিছু এখনও এখানেও উপস্থিত আছেন। এখন আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রবেশ করছি। দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তারা আমাদের শক্তি।

ইউনূস বলেন, এটি ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের একটি যাত্রা, এখন দেশের তৃতীয় প্রজন্ম উঠে আসছে, আমরা কি প্রস্তুত? এগুলো আমাদের চ্যালেঞ্জ।

নারীরা যে উদ্যোক্তা হিসেবে অন্য সবার মতোই সৃজনশীল, সে কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ''তরুণ প্রজন্ম পৃথিবী পরিবর্তন করবে, তাদের কাছে রয়েছে প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং সমস্যা সমাধানের উদ্ভাবনী ধারণা।

৫০ বছর আগে সমস্যাগুলো আমরা যেভাবে দেখতাম, এখন সেভাবে দেখার প্রয়োজন নেই। সরকার কিছু করে দেবে সেই অপেক্ষা করার বদলে, আমরাই তা করে নিতে পারি। এটা একটি পরিবর্তন।

তার ভাষায়, বাংলাদেশে ব্যবসা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি পুরো বিশ্বের জন্য হতে পারে।

গ্রামীণ আমেরিকার মত সফল উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কে ভেবেছিল, এক ছোট্ট গ্রাম থেকে জন্ম নেয়া ক্ষুদ্র ঋণ একসময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রাইম ব্যবসা গ্রামীণ আমেরিকা হবে।

বিনিয়োগ সম্মেলনে আসা ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে ইউনূস বলেন, "আমরা আপনাকে আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য স্বাগত জানাই, সেই মিশনে, পুরো বিশ্বের জন্য একটি নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য।"

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে ৭ এপ্রিল শুরু হয়েছে এই বিনিয়োগ সম্মেলন। চার দিনের এই সম্মেলনে দেশের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ সুযোগ এবং সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে।

স্পেন থেকে অস্কার গার্সিয়া, যুক্তরাজ্য থেকে রোজি উইন্টারটন এবং বাংলাদেশ থেকে নাসিম মঞ্জুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বাংলাদেশের ব্যবসা এবং বিনিয়োগ সম্ভাবনার ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কার এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পাইপলাইন গঠনের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নির্বাহী এবং নীতিনির্ধারকেরা এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।

এমটিআই

Link copied!