ঢাকা : চলতি বছর গরু কোরবানির সংখ্যা হতে পারে ৪৭ থেকে ৫০ লাখ। আর পুরো দেশের বাণিজ্যিক খামারে (সাদেক, সারা, নাবিল, আর.কে... এমন খামার) মোট গরুর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। কোরবানিতে যে পরিমাণ গরু কোরবানি হয় তার ৯৯ ভাগের দামই দেড় লাখ টাকার নিচে বা কম। সংখ্যাতত্ত্বে যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে খামারিরা কিভাবে গরুর দাম নিয়ন্ত্রণ করে তা বোধগম্য হয় না। প্রতি বছর ২৫ লাখের বেশি দামে সর্বোচ্চ ৫০টা গরু বিক্রি হয়। নির্দিষ্ট গ্রাহক যদি কিনতে আগ্রহী হন তাহলে খামারি তার গরুর দাম হাঁকাতেই পারেন। দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় এক দশক আগে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ করা হয়েছিল। মজার বিষয় হলো আমাদের দেশাত্মবোধটা, ওখানেই শেষ। এরপর থেকে গরুর খাবারের দাম যে প্রায় চারগুণ বেড়েছে সে খবর কে রাখে? ২০২৪ সালে এসেও হাঁটগুলোতে চোখের দেখায় গরুর ওজন নির্ধারণ করা হয়। যদিও এই প্রথা ধর্মসম্মত নয়; তারপরও এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি গরু ঢাকায় আনতে স্থানীয় হাটের হাসিল, ট্রাক ভাড়া, রাস্তার চাঁদা, খুঁটিতে গরু বাধার খরচ, উঁচু স্থানে গরু বাঁধার খরচ, ফ্যানের ভাড়া, লাইটের ভাড়া, খাবার খরচ, ওষুধের খরচ যে বেড়ে চারগুণ হয়েছে তার পরিষ্কার হিসাব কারও কাছে নাই। প্রতি কোরবানি ঈদ সামনে রেখে অন্তত দুই বছর আগে থেকে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা গরু ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। সিন্ডিকেট হলে সেখানে হয়। যেখানে কোন বছর রাজধানীর মানুষদের জিম্মি করে গরু বিক্রি হয়, কোন বছর ভয়াবহ লস করে ক্ষতির শিকার হয়ে ভগ্ন মনে খামারিরা বাড়ি ফিরে যান। আর গ্রামগুলোতে বিভিন্ন কৃষক পরিবার খুব ছোট পরিসরে গরু লালন পালন করেন। যার বেশিরভাগই থাকে বড়ো আকারের গরু। কোন ধরনের বাজার বিবেচনা না করেই তারা গরুর দাম নির্ধারণ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। দিন শেষে ছয় লাখ টাকার গরু দেড় লাখেও অবিক্রীত থেকে যায়। এই এক অদ্ভুত দেশ, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করা হয় শুধু মাত্র ধারণা বা আন্দাজের ওপর। পাইকারদের আশা থাকে বৃষ্টি না হলে গরুর দাম বেশি পাওয়া যাবে, গরুর আমদানি কম হলে গরুর দাম বেশি হবে আর গ্রাহকের স্বপ্ন থাকে রাতে গরুর দাম অবশ্যই কমে যাবে। ঢাকার বাইরে থেকে যারা গরু নিয়ে আসেন তাদের অধিকাংশেরই ধারণা যে রাজধানীর মানুষ লাখ টাকার নিচে কোরবানি দেয় না। তবে ঢাকার প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ যে লাখ টাকার নিচে গরু কোরবানি দেওয়ার জন্য হন্যে হয়ে হাটে হাটে ঘেরেন, সে বাস্তবতা পাইকাররা কোনোভাবেই মানতে চান না। মোট কথা ৫৪ বছর ধরে কোন ধরনের নিয়ম ছাড়া শুধুমাত্র ধারণার উপর চলছে দেশের সব থেকে বড়ো ব্যবসায়ীক কার্যক্রম। হাটগুলোতে শুধুমাত্র গরু মারা যাওয়ার উপক্রম হলেই চিকিৎসকের দেখা মেলে, কিন্তু সুস্থভাবে হাটে প্রবেশ করানো হয়েছে নাকি তা পরীক্ষার কোন উপায়ই নেই।
এতক্ষণ তো বললাম গরুর দামের বিষয়ে। গরু কিনে বাসায় যাবার সময় গরুর দাম জিজ্ঞেস করা আর চিৎকার করে তার উত্তর দেয়াও আমাদের ঐতিহ্য। সেখানে যিনি দুই লাখ টাকার গরু কিনে বাড়ি ফেরেন রাস্তায় তাকে রাজা বিবেচনা করা হয়। আর যিনি ৬০ থেকে ৭০ হাজারে গরু কিনতে পারেন তাকে টিপ্পনী শুনতে হয়, ভাই আপনে বাছুর পাইছেন। টানাটানি বাজেটে গরু না হয় কেনা গেলো। গরু কেনার পর বড়ো চিন্তার বিষয় কসাই। কসাইয়ের ছদ্মবেশে রিকশাচালকরা যাতে গরু কাটতে না বসে পড়ে সেটাই থাকে বড়ো চিন্তার বিষয়। অথচ দেশে কোরবানির পশুর উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও কসাইয়ের কাজ কেনো কেউ শিখতে চায় না। এ বিষয়ে ভাবার কারও কোন সময়ই নেই। অথচ দক্ষ হাতে চামড়া ছিলতে না পারার কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ পিস গরুর চামড়া নষ্ট হয়। ভারত থেকে গরু আমদানি কখনই সমাধান হতে পারে না। তবে ৯৯ ভাগ মানুষের সামর্থের কথা বিবেচনা করে কেনো ছোটো গরু উৎপাদন করা হয় না সে প্রশ্নের উত্তরও এখন পর্যন্ত কারও কাছে নেই।
সরকারীভাবে কেনো হাটের ব্যবস্থা করা হয় না, ইজারাদারদের দাপটে সে উত্তর হয়তো কখনই কেউ দেবে না। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে যদি কোন ক্রেতা বা পাইকার প্রতারিত হয়ে থাকেন তার শাস্তি কি হবে সেটাও হয়তো কেউ জানেন না। খামারে যারা লাখ লাখ থেকে কোটি টাকার গরু বিক্রি করছেন তাদের ভ্যাট বা ট্যাক্সের পরিমাণ কতো সে হিসাবও প্রতি বছর গোপনই থাকে। ধর্মীয় বিধানে না থাকলেও যারা লাইভ ওয়েটে গরু বিক্রি করে থাকেন তাদের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কে দিয়েছেন সে বিষয়েও কেউ ভাবেন না। উট দুম্বা অথবা শাহী জাতের গরু গুলো আমদানি কিভাবে হয় সে হিসাবও নেয়ারও সময় হয়তো এসেছে। দেশে ৫০ বছরের গবেষণায় প্রান্তিক পর্যায়ে সফলতা নেই বলেই, বড়ো ব্যবসায়ীরা বংশ মর্যাদার গরুর কথা বললে আমরা হা করে তাকায় থাকি। মাইকিং করে গরুর হাটের খবর সবাইকে জানান দিয়ে যে উৎসব মুখর পরিবেশ শুরু হয় তা শেষ হয় ক্রেতা আর গরুর পাইকারের একে অপরকে দোষারোপের মধ্য দিয়ে।
কারণ আমরা সবাই ৫ দিনের জন্য গরু নিয়ে চিন্তা করি। বাকি ৩৬০ দিন এ বিষয়টি আমরা ভুলে যাই।
লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, যমুনা টেলিভিশন।
আপনার মতামত লিখুন :