ঢাকা : করোনা পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত সমগ্র বিশ্ব। সব ক্ষেত্রে সব ধরনের কার্যক্রম থমকে গেছে করোনার কারণে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম হয়নি। করোনা মহামারীর প্রকোপে দেশের সব ক্ষেত্রে কেমন যেন একটা ধস নেমে এসেছে। বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর ১৮ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে শিক্ষা বোর্ড। এ বছরও এখন পর্যন্ত এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা নেওয়া হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু হয়েছে গত বছর থেকেই। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের আওতায় সব শিক্ষার্থীকে আনা সম্ভব হয়নি। দেশের প্রায় সব জায়গায় সব ধরনের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছিল, যদিও করোনার কারণে তা আবারো বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এ বছরের শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত প্রায় সব ক্ষেত্রে সব ধরনের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করে। এমতাবস্থায় সবার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে-করোনার প্রকোপ কি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বেশি? কারণ সবকিছু চলছে; কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন? সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মতামত শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের জীবনকে কোনোভাবেই হুমকির মুখে পড়তে দেওয়া যাবে না। এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবারো প্রায় অচল দেশ। ১৭ মে হল খোলার এবং ২৪ মে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে।
সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানতে পেরেছি অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলেছে। তার মধ্যে রয়েছে-সৃজনশীল কাজ, বহু নির্বাচনী প্রশ্ন, নির্ধারিত সময় ধরে শ্রেণি পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া। এসব পরীক্ষা নেওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের ডিভাইসের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন চালু থাকতে হবে। এমন কিছু নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু যার স্মার্টফোনই নেই সেই শিক্ষার্থী কীভাবে এই নীতিমালা মেনে অনলাইনে পরীক্ষা দেবে? এমন একটা প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই সেশনজট ছিল। এখন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তীব্র আকার ধারণ করেছে সেই সেশনজট। যদিও বেসরকারি মেডিকেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগে থেকেই অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের বিষয়টি আলাদা। কারণ যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তাদের প্রায় সব শিক্ষার্থীই স্বচ্ছল পরিবারের। আর এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের অনলাইন ক্লাস করার যাবতীয় সামগ্রী ছিল। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশের স্মার্ট ফোন নেই।
গত এক বছরেরও বেশি সময়ে সব থেকে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় আছে শিক্ষার্থীরা। কিছুদিন পরপর খোলার তারিখ পেছানোর কারণে শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। যদিও এর ওপর কারো হাত নেই। মহামারীর কারণে এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু আখেরে ক্ষতির সম্মুখীন শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে। এ কারণেই বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। এরই মাঝে গত বছরের শেষের দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনার্স ফাইনাল ইয়ার এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের করোনার কারণে আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো নেওয়া শুরু করে। একে একে অন্যান্য সকল বর্ষের বন্ধ হওয়া পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা চলতে থাকে। এতে বাকিদের পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু বিধিবাম! হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সকল পরীক্ষা স্থগিত করে। এই সিদ্ধান্তটা শিক্ষার্থীদের জন্য খালি পেটে লাথি মারার মতো বিষয় ছিল। কারণ করোনার শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর শিক্ষার্থী বাসায় চলে যায়। পরে যখন হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে তখন পরীক্ষার্থীরা মেসে ওঠে। অনেক বেশি টাকা অগ্রিম দিয়ে বাসা নেয়। ছাত্রীরা অনেক কষ্ট করে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সকল পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেখানে একটি বড় অংশ শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস এর আওতায় আনতে পারেনি, সেখানে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হাস্যকর বিষয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের। অনেকেরই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল এবং ল্যাপটপ নেই। এমতাবস্থায় তারা ক্লাসই করতে পারছে না। আর সকল বিষয়ের ক্লাস ঠিকমতো নেওয়া হচ্ছে কি না তাতেও সন্দেহ আছে। এ ছাড়া ডাটা প্যাক এর দাম অনেক বেশি। গ্রাম অঞ্চলে স্বাভাবিক কথা বলার মতো নেটওয়ার্কই থাকে না সব সময়, সেই সব অঞ্চলের শিক্ষার্থী কীভাবে পরীক্ষা দেবে।
একের পর এক অদূরদর্শী পরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এমনিতেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী এত দীর্ঘ সময় বাড়িতে থাকার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ ছাড়া করোনার কারণে অধিকাংশের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এত ঝামেলার মধ্যে বার বার খোলার তারিখ পেছানো এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে মানসিক চাপ এবং মানসিক অবসাদ কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক শিক্ষার্থী ছিল যারা টিউশন করে পড়াশোনার খরচ চালাতো তাদের অর্থনৈতিক এবং মানসিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ। তাদের অনেকের তো চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
যারা অনার্স ফাইনাল ইয়ার বা মাস্টার্সের ছিলেন তাদের পরীক্ষা শেষ না হওয়ার কারণে তারা চাকরির আবেদন করতে পারছে না। এই শিক্ষার্থীদের তো পরীক্ষা দিতেই হবে; কিন্তু তাদের অনেকেরই স্মার্ট ফোন না থাকার কারণে তারা অনলাইন পরীক্ষা দিতে অক্ষম। দেশে ৫০ লাখের অধিক উচ্চ শিক্ষিত বেকার। করোনার কারণে এখন যুক্ত হয়েছে অনেক এবং ভবিষ্যতেও হবে। ফলে এত সমস্যার মধ্যে মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একজন শিক্ষার্থীও যদি মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করে তাহলে সেই দায়িত্ব কে নেবে? তাই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিত।
এ বছরের শুরুতে হঠাৎ করে পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্তটা যে অযৌক্তিক ছিল তা এখন হাড়ে হাড়ে বোঝা যাচ্ছে। তখন যেভাবে শুরুটা হয়েছিল তাতে করে এতদিনে অনার্স চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সের যদের পরীক্ষা আটকে ছিল তাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে বাকিদের পরীক্ষাও প্রায় শেষের পথে থাকত। দুই তিন ব্যাচ করে পরীক্ষা নিলে জনসমাগম কম হতো এবং এই দুর্ভোগও পোহাতে হতো না। শিক্ষার্থীরা হলো জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের যদি ক্ষতি হয় বা তারা যদি পিছিয়ে পড়ে তাহলে জাতি পিছিয়ে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয় হল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানে গ্রহণ করা যে-কোনো সিদ্ধান্ত পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য দৃষ্টান্ত হবে।
সেশনজট নিরসনে পরীক্ষা জরুরি। তবে সেই জরুরি বিষয় নিয়ে যেন হাসির কাণ্ড না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনলাইন পরীক্ষার আগে সব শিক্ষার্থীর উপস্থিতির বিষয়টা বিনেচনা করতে হবে। কারণ যারা গ্রামে রয়েছে তারা নেটওয়ার্ক সুবিধা থেকে অনেক পিছিয়ে। তা ছাড়া দীর্ঘ ছুটির ফলে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থাও ভালো না অভাব অনাটন, হাহাকার কান্না সব মিলিয়ে একটি বিচ্ছিরি অবস্থা। সুতরাং এমন সময় হুটহাট সিদ্ধান্ত যে-কোনো শিক্ষার্থী মেনে নিতে পারবে না। মানসিক চাপ সৃষ্টি হবে। তাই জাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে একটি গোছানো আর সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত দরকার।
লেখক : পরিসংখ্যান বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
আপনার মতামত লিখুন :