ভারতীয় ধরন মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়

  • আশরাফুল ইসলাম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ২০, ২০২১, ১১:১৫ এএম
ভারতীয় ধরন মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়

ঢাকা : পুরো বিশ্ব এখন করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের আঘাত করোনার সংক্রমণকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের আঘাতে ভারতে করোনা পরিস্থিতি বর্তমানে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রতিদিনই আক্রান্তের হার ও মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে। দেশটিতে বর্তমানে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই প্রায় চার লাখেরও বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলো এখন আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি যে চিতায় দাহ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার ভয়াল ছোবলে পুরো ভারত যেন এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। মরদেহের ঠাঁই হচ্ছে না মর্গেও। ভারতে ডাবল মিউট্যান্ট আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি ট্রিপল মিউট্যান্ট আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ভাইরাস যত ছড়ায়, তার মিউটেশনের হারও তত বৃদ্ধি পায়। যে-কোনো ভাইরাস ক্রমাগত নিজের ভেতর নিজেই মিউটেশন ঘটাতে থাকে বা নিজেকে বদলাতে থাকে। ফলে ভাইরাসের নানা ধরন তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন মাথাব্যথার প্রয়োজন হয় না। কারণ নতুন সৃষ্ট অনেক ভ্যারিয়েন্ট মূল ভাইরাসের চেয়ে কম দুর্বল ও ক্ষতিকর হয়ে থাকে। আবার কিছু ভ্যারিয়েন্ট অনেক ছোঁয়াচে হয়ে থাকে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মূলত এগুলোর একটি। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় এই চারটি রাজ্যে নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে নেপালেও হানা দিয়েছে। ভারতে যে দুটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে তা সারা বিশ্বে বিরল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা স্ট্রেইন মিলে তৈরি হয় নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ক্ষমতাও তিনগুণের বেশি হয়ে থাকে। তা ছাড়া নতুন এই স্ট্রেইনে আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের চারদিকে সংক্রমণ করার ৩০০ গুণ ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিএমআরের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত একজন রোগী ৪০৬ জনের শরীরে করোনা ছড়াতে পারে। তবে এখনো পযর্ন্ত নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বিশেষ কোন তথ্য নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। যে কারণে আপাতত ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নের বদলে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্টের তালিকাতেই রাখা হয়েছে এটিকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ধরন শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে আইইডিসিআর। বাংলাদেশ যেখানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে যেখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিত যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে করোনার লাগাম টেনে ধরার জন্য লকডাউন চলছে। লকডাউনে আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। লকডাউনে বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করেই নাড়ির টানে ঢাকা ছাড়ছেন হাজারো মানুষ। রাস্তাঘাট, শপিংমল ও ফেরিঘাটে দেখা যাচ্ছে মানুষের অস্বাভাবিক ভিড়। কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এতে করে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে সরকার ১৪ দিনের জন্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। তবে এই ঘোষণা পর্যাপ্ত নয়। কারণ সরকারের এই নির্দেশনা কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা না গেলে তাতে কোনো ফল আসবে না। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে চলছে পণ্য পরিবহন। পরিবহন সংশ্লিষ্ট লোকজন ও সাধারণ যাত্রীদের নিত্য আসা-যাওয়ার খবর মিলছে। সেখানে মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। ভারত থেকে আসা যাত্রীদের সর্বোচ্চ কোয়োরেন্টান নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। ভারতীয় ধরনের বিস্তার রোধে অভ্যন্তরীণ চলাচলের পাশাপাশি বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এটার সঠিক মনিটরিং করা প্রয়োজন। কঠোরভাবে চলাচল নিয়ন্ত্রণ বিশ্বব্যাপী কোভিডের বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণে সাফল্য পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ব্যাপকভিত্তিক সিকোয়েন্সের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতে করে ভারতীয় নতুন ধরনটি কতটুকু ছড়িয়েছে সে সম্পর্কে একটা সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। পাশাপাশি ভারতের এই ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশের জন্য কতটুকু বিপজ্জনক তাও খতিয়ে দেখা দরকার। অন্যদিকে আমাদের ডাটাবেজও ডেভেলপ করা দরকার। যদি অধিকাংশ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা যেত তাহলে ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসত। তা ছাড়া বিদেশ থেকে আসা নাগরিকদের নমুনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের ওপরও অধিক জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে আসা ভারতীয় ট্রাক, ড্রাইভার ও শ্রমিকরা যখন পণ্য আনলোড করার জন্য বন্দর এলাকায় প্রবেশ করে তখন তারা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই বন্দরে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে অবাধে মিশছেন। এর ফলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়ানোর উচ্চ সম্ভাবনা থাকছে। এ ক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি যদি নিশ্চিত করা না যায় প্রয়োজনে আমদানি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ সবার আগে মানুষের জীবন, তারপর অন্য কিছু।

ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে হাসপাতাল, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। এমতাবস্থায়, যদি ভারতীয় ধরন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বহু মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। এ কারণে সব ধরনের সতর্কতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা দরকার। মানুষকে তথ্য জানাতে হবে, তথ্য জানালে মানুষ সতর্ক হবে। আমাদের সকলকেই স্বাস্থ্যববিধি মেনে চলতে হবে। মুখে সার্বক্ষণিক মাস্ক পরিধান, সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোঁয়া এবং একে অন্যের থেকে নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। হাত না ধুয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা যাবে না। রুমাল বা টিস্যু না থাকলে কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দিতে হবে। ব্যবহূত রুমাল, টিস্যু এবং মাস্ক যেখানে-সেখানে ফেলা যাবে না। মাঠপর্যায়ে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্বে রয়েছেন তাদের আরো কঠোর হতে হবে। তবে করোনা সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরার জন্য দরকার সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Link copied!