ঢাকা : পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা করোনা ভাইরাস। এটি একটি মহামারী এবং বৈশ্বিক সমস্যা, যা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। নিত্যনতুন করোনা ভাইরাসের ধরন দুশ্চিন্তার কারণ। এই সমস্যা মেটাতেই যখন পৃথিবীর সব দেশ হিমশিম খাচ্ছে তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলা দ্বন্দ্ব, যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি সমাধান করার মতো সময় মানুষের হাতে নেই। করোনা ছাড়াও মানুষ লড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সঙ্গে। করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যেই পৃথিবীর কয়েকটি দেশে সংঘাত, দ্বন্দ্ব প্রভৃতির কারণে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। সমস্যাসমূহ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। দরিদ্রতার কারণে ক্ষুধা এবং জীবনযাত্রার হুমকির মুখে মানুষের স্থানচ্যুতি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে এই উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ বা আফ্রিকার শিং নামে পরিচিত উত্তর পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া এবং অন্য দুর্ভাগা দেশটি হলো ইয়েমেন।
ইয়েমেনের সংকটময় পরিস্থিতি শুরু গত কয়েক বছর ধরেই। যার কোনো কূল-কিনারা হচ্ছে না। আর ইথিওপিয়ার সংকট শুরু হয়েছে গত বছরের শেষ দিকে। দুুটি দেশেই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে (ইথিওপিয়ার টাইগ্রেতে) এবং শিশুদের পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ। খাদ্য সংকট ওই অঞ্চলগুলোতে নিত্যদিনকার ঘটনা যা দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত বছরের শেষ দিকে মূলত ইথিওপিয়ায় আভ্যন্তরীণ সংঘাতের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধে সংঘাতপ্রবণ অঞ্চল আজ বিপর্যস্ত। সেখানে মানুষ আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ টাইগ্রেসহ বিভিন্ন এলাকায় সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সঙ্গে সংঘাত চলছে। এই চলমান সংঘাতের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইথিওপিয়ার জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা ৫৪৭টি। এর মধ্যে টাইগ্রেতে আসন আছে ৩৬৮টি। অন্যান্য বিদ্রোহী এলাকাগুলোর আসন রয়েছে মোট ৬৪টি। যে অঞ্চলে এই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে সেখানেই আসন সংখ্যা বেশি। দেশের ৫ কোটি ভোটারের মধ্যে ২১ জুন ভোট দিয়েছেন ৩ কোটি ৭০ লাখ ভোটার। টাইগ্রেসহ দেশটির সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলো এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১৮ সালে আবি আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম নির্বাচন হবে এটি। আফ্রিকা মহাদেশের গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যপীড়িত এই দেশে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৫ সালে।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, যিনি ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই যুগের যুদ্ধ অবসানে অবদান রাখার জন্য। সেই দেশেই এখন সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিষয়টি অবাক করার মতো হলেও সেখানে অশান্তি চলছে। মানুষ খাদ্যাভাবে রয়েছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই প্রধানমন্ত্রীর দেশে এখন অশান্তির আগুন জ্বলছে। ইথিওপিয়ার যুদ্ধের ক্ষত অনেক পুরাতন। যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে মানুষের জীবন, সম্পদ, চাহিদা সবকিছুই মূল্যহীন। যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে এটাই ঘটে। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ টাইগ্রেতে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য তিনি অস্ত্রের প্রয়োগ করছেন। টাইগ্রে হলো ইথিওপিয়ার ১০টি আধা স্বায়ত্তশাসিত ফেডারেল রাজ্যের একটি। কোনো দেশের সংঘাত সবসময় সে দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না তার প্রভাব প্রতিবেশী দেশেও পড়ে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। আশ্রয়ের জন্য ছুটছে মানুষ। বাস্তুচ্যুত মানুষ আজ বিশ্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সংঘাত শুরুর পর সেখানে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। আর বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ-সংঘাত সেই চ্যালেঞ্জকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। এখন যেমন ইথিওপিয়াকে সংকটে ফেলছে।
২০১৮ সালে আবি আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর দুই দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। তিনি ক্ষমতায় আসার পর উদারপন্থী রাজনীতির পথে হাঁটেন। গত বছরের নভেম্বরে টাইগ্রেতে ইথিওপিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে আকস্মিক হামলার পর দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় এই প্রদেশের ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল টিপিএলএফ-কে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে আইনের শাসন ফেরাতে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন আবি আহমেদ। সেই অবসানের বেশি সময় যেতে না যেতেই ফের নতুন করে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হতে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতি না থামলে তা ঘটতেই পারে। আর গৃহযুদ্ধ যে কতটা ধ্বংসাত্মক তার উদাহরণ ইতিহাসে বহু রয়েছে। সে দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো ,শিক্ষাসহ সব বিষয় মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ইথিওপিয়ায় টাইগ্রের লোকজনের প্রভাব অনেকদিনের। আর টিপিএলএফ হলো টাইগ্রের জনপ্রিয় দল। গত ৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনে টিপিএলএফ জয়লাভ করে। এই নির্বাচনকে আবি আহমেদ সংবিধান লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে সেনা মোতায়েন করে। ফলে পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। ইথিওপিয়ার ইতিহাসে, ১৯৯১ সালে টিপিএলএফ নেতৃত্বাধীন জোট ইথিওপিয়ান পিপলস রেভল্যুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সামরিক ক্ষমতা দখল করে। এই জোট প্রায় ২৭ বছর ক্ষমতায় ছিল। কয়েক দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৯৩ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে ইথিওপিয়া থেকে ইরিত্রিয়া স্বাধীন হয়।
যুদ্ধ কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তবু এ পথেই হাঁটছে পৃথিবীর সচেতন মানুষ। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ নাম ইয়েমেন। অথচ আজ এই দেশটিই নির্মম পরিহাসের শিকার। সেখানকার শিশুদের শৈশবের শুরুটা এখন ভয়াবহ। জাতিসংঘের হিসেবে, এই বছর সেখানে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ না খেয়ে থাকবেন। পাঁচ বছরের কম বয়সী চার লাখ শিশু না খেয়ে মারা যেতে পারে। ২০১৫ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদুরাব্বু মানসুর হাদিকে উচ্ছেদ করে রাজধানী সানা দখলে নেয় হুথি বিদ্রোহীরা। পালিয়ে রিয়াদ আশ্রয় নেয় সৌদি সমর্থিত প্রেসিডেন্ট হাদি। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘অপারেশন ডিসাইসিভ স্টর্ম’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে রিয়াদ। এই দ্বন্দ্বে আজ ইয়েমেন পরিচিতি পেয়েছে দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে। ছয় বছর ধরে টানা যুদ্ধে দুর্ভিক্ষে আজ নাকাল ইয়েমেন।
গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হলো ইয়েমেন। যার কোনো সমাধান আজও হয়নি। কার্যত কোনো সমাধানের লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ইয়েমেন বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্টিন গ্রিফিথ দেশটিতে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় তার ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন। সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট গত প্রায় ছয় বছর ধরে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাচ্ছে। সেখানে মানুষ মরছে, আশ্রয়হীন হচ্ছে, শিশুরা ক্রমাগত খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে; কিন্তু এতে সমাধানের কোনো পথ নেই। এই আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ১৭ হাজারেও বেশি ইয়েমেনি নিহত হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে দৃশ্যমান কোনো সিদ্ধান্ত দেখা যায়নি। জাতিসংঘের দিকে সমাধানের আশা ছিল। কিন্তু আজও তা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীজুড়ে এমনিতেই মানবিক সংকট রয়েছে। যুদ্ধাক্রান্ত দেশ, দারিদ্র্য জর্জরিত দেশের মানুষেরা মানবিক সংকটে ভুগছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জেরে মানুষ আশ্রয়হীন হয়, খাদ্য সংকটে ভোগে, চিকিৎসা সংকট দেখা দেয়। মোটকথা মৌলিক চাহিদা পূরণ কষ্টসাধ্য হয়ে পরে। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়।
ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধে সেখানকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। দুুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেখানকার মানুষকে। ইয়েমেনের এই পরিণতির জন্য কি ইয়েমেন দায়ী না বিশ্বের ক্ষমতালিন্সু মনোভাব দায়ী? মানবতা, মানবাধিকার— এ শব্দগুলো মানবসভ্যতার মাপকাঠির নির্ধারক হলেও আজকের বিশ্বে তা বেমানান। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। যুদ্ধ কেবল ধ্বংস করতে পারে। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে সব জায়গাতেই রয়েছে পীড়িত মানুষের আর্তনাদ। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের খাদ্যের অধিকার রয়েছে। কেউ ক্ষুধার্ত থাকার কথাও না। বরং মানুষের প্রধান পাঁচ মৌলিক অধিকার পূরণ করা যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেখানে আজ বিশ্বনেতৃত্বের খামখেয়ালিপনা পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে করে তুলেছে ভাগ্যবিড়ম্বিত। সুতরাং যত কথাই বলা হোক না কেন, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে, দেশে দেশে গৃহবিবাদ, সংঘাত, যুদ্ধ, অনাহারী মানুষের আর্তনাদ, শেকড়চ্যুতি— এসব কিছুর দায় স্বীকার করে নিতে হবে আজ বিশ্বনেতৃত্বকেই।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
আপনার মতামত লিখুন :