করোনাকালে কপাল পুড়ছে কিশোরীদের

  • মুস্তাফিজ সৈয়দ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২১, ১০:৩৩ পিএম
করোনাকালে কপাল পুড়ছে কিশোরীদের

ঢাকা : বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে থমকে গিয়েছে স্বাভাবিক মানব জীবন, থমকে আছে পুরো বিশ্ব কিন্তু থেমে নেই বাল্যবিবাহ বরং করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুবাদে ক্রমশহারে বেড়েই চলেছে বাল্যবিবাহের হার। মহামারী জীবনঘাতক করোনা ভাইরাসের সর্বগ্রাসী আক্রমনে ভালো অবস্থায় নেই মানুষেরা। মধ্যবিত্তের ঘরে অভাব অনটনের চোর পুলিশ খেলা আর অসহায় হতদরিদ্র মানুষজন মরছে অর্থ কষ্টের নিদারুণ যন্ত্রনায় জীবন-মরণ খেলায় পৃথিবীর নামের নাট্যমঞ্চে। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্কুল স্টাফসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গত ১৮ মার্চ, ২০২০ হতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দিবারাত্রির হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে ৫০৫ দিন হলো (০৫/০৮/২০২১)। জীবনবন্দি এই মহামারীকালে অনেক কিছু নিরবে বদলে যাচ্ছে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঝরে গিয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী, অনেক মানুষ তার চাকরি হারিয়েছেন, অনেক ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আমাদের জীবনে ঘটে চলা সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে তবে শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে অধিক ভাবতে হবে সবাইকে কেননা শিক্ষা ব্যতীত জীবনের অর্থ উন্মোচিত হয়না,ইতিবাচক পরিবর্তন হয়না,সার্বিক উন্নয়ন সাধন হয়না। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানাস্তরে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা ) অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নারী। বিশেষ করে মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে কোমলমতি কিশোরীরা যাদের চোখে স্বপ্ন সুন্দর আগামীর কিন্তু এখন শুধুই তাদের দু’চোখে মানব-সমুদ্রের নোনাজল। করোনা ভাইরাসের থাবায় অনেক মানুষ চলে গেছেন মহাজাগতিক ভ্রমণে আবার যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বপ্নও মরে গিয়েছে। যেমন বলা যায় একদিকে অভিভাবকদের অর্থ উর্পাজনের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে আবার অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তাই সবকিছুর সমীকরণে মধ্যবিত্ত হতদরিদ্র বাবা-মা তাদের কন্যাকে তুলে দিচ্ছেন পাত্রের হাতে। বাল্যবিবাহের ফলে অকালে ঝরছে অসংখ্য মুকুল, হচ্ছে কিশোরীদের স্বপ্নভঙ্গ। অভাব যখন দরজায় তখন মানুষের ভবিষ্যত সুযোগ, ইতিবাচক সম্ভাবনা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়, এই সময় মানুষ ভীষণ অসহায়, বড় নিরুপায়। বাল্যবিবাহ আমাদের সমাজে ভয়াবহ ব্যাধি আর বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনাতে এই ব্যাধি আরো বেশি প্রভাব বিস্তার ও শক্তি সঞ্চার করেছে বহুমাত্রায়। করোনাকালে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় মানসিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যার ফলে বাল্যবিবাহের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করা যায় মানুষের অজ্ঞতা,অসচেতনতা, নিরাপত্তাহীনতা, করোনায় সৃষ্ট হওয়া অভাব অনটন ইত্যাদি। করোনাকালে নষ্ট হয়েছে মনের শান্তি,যুক্ত হয়েছে অবসাদ, বিষন্নতা, অশিক্ষা,অভাব-অনটন,দীনতা এসব কিছু বাল্যবিবাহের নীরব প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সারাবিশ্বে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ।

দেশের প্রায় ৫১ শতাংশ মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার। বিগত দুই বছরে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্র্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে এবং ২২ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছরের আগে কিন্তু করোনাকালে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২৫ বছরের মধ্যে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। প্রায় দু’বছর হয়ে গিয়েছে দেশের সকল ধরণের শিক্ষপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং একই সাথে কর্মসংস্থানের সংকট প্রকটরূপ ধারণ করেছে। এই করোনায় চাকরি চলে গিয়েছে অনেকের আবার যাদের চাকরি রয়েছে তারাও নামমাত্র বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন। নানাবিধ কারণে সৃষ্ট হওয়া অভাব অনটন ও জটিলতায় গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন পরিবারগুলো ঝুঁকির মুখোমুখি। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় দেশে যেমন পর্যাপ্ত কমসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে তেমনি প্রবাসে চাকরি থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন অনেক শ্রমিক যার ফলে দেশে চলে আসছেন প্রবাসীদের একাংশ। দেশে ফিরে এসে প্রবাসীরা বিয়ের পর্বটা সেরে নিচ্ছেন। আবহমান কাল থেকেই গ্রাম বাংলা কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আমজনতার পছন্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়ে আসছেন প্রবাসীরা। প্রবাসীরা বিয়ের ক্ষেত্রে অল্পবয়সী মেয়েদের পছন্দ করে থাকেন আর এ সুযোগে অভিভাবকরাও তাদের কমবয়সী মেয়েকে তুলে দিয়ে থাকেন বয়সী পাত্রের হাতে।

লকডাউনে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় বিয়েতে অর্থব্যয় হ্রাস পেয়েছে, ঘরোয়া পরিবেশে স্বল্পঅর্থ ব্যয়ে হয়ে যাচ্ছে বিয়ে। এ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করছে মধ্যবিত্ত ও হতদরিদ্র পরিবার। করোনাকালে দেশের যেসব পরিবার জীবন-জীবিকার সংকটে নাজেহাল,অভাবে নিঃশেষ সেসব পরিবারের বাবা-মা তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাদের পাত্রস্থ করে চিন্তামুক্ত হতে চাইছেন। বৃহৎ পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষজন ভাবে মেয়েদের বিয়ে দিলে মুক্তি পাওয়া গেল। এই অমূলক ভাবনা বেশি ভর করেছে বাংলাদেশের উপর যার প্রভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। চিন্তামুক্ত হতে গিয়ে অভিভাবকরা হারিয়ে বসে তাদের সন্তানকে কেননা অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার পরে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয় যেমন অকালে গর্ভধারণ,মৃত্যু ইত্যাদি। কন্যাশিশুর চিন্তামুক্তি দিনশেষে অভিভাবকদের দাঁড় করায় মানসিক দুঃখ দুর্দশা হতাশার কাঠগড়ায়, বিবেকের আদালত তো আর বেঁচে নেই, এখন ভরসা এই মানসিক দুঃখ দুর্দশা হতাশার ভঙ্গুর কাঠগড়া। বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করছে যেমন শিক্ষা,অবকাঠামোগত, শিল্প, কর্মসংস্থান ইত্যাদি তবে আমাদের দেশে উন্নয়ন স্থায়ীরূপ লাভ করেনা তথা টেকসই হতে পারেনা, টেকসই না হওয়ার পিছনেও নিশ্চয়ই কোন এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার কমে এসেছিল কিন্তু করোনাকালে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাল্যবিবাহের লাগাম টেনে ধরতে হবে, লাগাম টেনে না ধরতে পারলে টেকসই উন্নয়ন অর্জন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি  বলেন “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিশুবিয়ের ব্যাপকতা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। লাখ লাখ মেয়েশিশু যে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে তা আরও জটিল করে তুলেছে কোভিড-১৯।

স্কুল বন্ধ থাকা, বন্ধুবান্ধব এবং সহায়তা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য মেয়েদের শিশুবিয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।” জাতিসংঘের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে বলা হয় “ বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জীবিত প্রায় ৬৫ কোটি মেয়ে ও নারীর বিয়ে হয়েছিল তাদের শৈশবে, যার প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে বাংলাদেশ,ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, ভারত ও নাইজেরিয়ায়।” বাংলাদেশ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে চিরকাঙ্খিত স্বপ্নের দিকে লক্ষ্যের দিকে। কোভিড ১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ভবিষ্যত জীবনে এগিয়ে চলা এবং এসডিজি তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনে প্রতিবন্ধকতার এক পাহাড় হয়ে দাঁড়াবে করোনাকালে বেড়ে যাওয়া এই বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধি। ইউনিসেফ কনসালটেন্ট পুলিক রাহা বলেন “কোভিড আসার পরে পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করে ফলে তারা মেয়েদেরকে বিয়ে দিতে শুরু করলেন।” সময় এখন অস্থির, এখনই ধরতে হবে শক্ত হাতে পাগলা ঘোড়াকে নইলে বাল্যবিবাহ নামক ব্যাধিতে শেষ হয়ে যাবে কোমলমতি কিশোরীদের সোনালী ভবিষ্যত। করোনাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক সংস্থা গবেষণার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের প্রকৃতচিত্র তুলে ধরেছে।

ব্রাকের গবেষণায় উঠে এসেছে প্রকৃত তথ্য ৮৫ শতাংশ অভিভাবক উল্লেখ করেছেন, করোনাকালে জীবিকার সংকট থাকায় তারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এ কারণে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কন্যাশিশুদের বিয়ে দিতে আগ্রহী। ৭১ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন স্কুল খোলায় অনিশ্চয়তা থাকার এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তাবোধে বাল্যবিবাহের প্রতি ঝুঁকছেন। ৬২ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন প্রবাসী ছেলে সহজেই পেয়ে যাওয়ায় তারা কন্যাশিশুদের ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ জানাচ্ছে ৩ বছর ধরে দেশজুড়ে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। আর্ন্তজাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে বলা হয় বিশ্বব্যাপী এ মুহূর্তে ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, যার মধ্যে ২ লাখ দক্ষিণ এশিয়ার। প্রায় ১০ লাখ বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয় করোনার কারণে ২০২৫ সাল নাগাদ বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে ২ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। পুরো বিশ্ব  বাল্যবিবাহ নামক এক মহাঝুঁকির মুখোমুখি হবে, একে জয় করা অনেক দেশের জন্যই কষ্টকর হবে। বাল্যবিবাহের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাল্যবিবাহের সঙ্গে প্রজনন স্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধির সম্পর্ক রয়েছে। ইউএনএফপি’র  এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশসহ ৫৭টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ ও মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায় এ ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা কম। আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে থাকে। করোনাকালে তা আরও বেড়ে গিয়েছে এবং কোভিড-১৯ মহামারীতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নারীর প্রতি সহিংসতা ও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীদের অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত ও অনিরাপদ সন্তান প্রসবের ঘটনা বাড়ছে, সন্তান ও কিশোরী মায়ের অপুষ্টিজনিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কোভিড-১৯ ও বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে প্লান ইন্টারন্যাশনাল একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের জরিপ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ কুড়িগ্রামে সংঘটিত হলেও করোনাকালে দেশের প্রতিটি জেলায় বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, করোনাকালে নিবন্ধিত বিয়ে কমছে; বাড়ছে অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা, যার মূলত পুরোটাই বাল্যবিবাহ।

প্লান ইন্টারন্যাশনাল জরিপ চালিয়েছে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। এখন ২০২১ সালের আগস্ট মাস, এখন যদি জরিপ করা হয় তাহলে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কত হতে পারে তা আমাদের নিজেদেরকেই বুঝে নিতে হবে। অর্থনৈতিক অভাব,সুশিক্ষার যথাযথ চর্চা, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং, ভবিষ্যত জীবনে কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা, কন্যাশিশুর নিরাপত্তাহীনতা, যৌন নির্যাতন, মানসিক হয়রানীসহ নানাকিছু বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অদৃশ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হওয়া সহ পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধায় নারীশিক্ষার প্রসার বেড়েছে ঠিক কিন্তু শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নতি দিয়ে তো আর কিশোরীদের ভবিষ্যৎ যাত্রা নিরাপদ করা যায়না। কিশোরীদের সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণের নিশ্চয়তাই পারে নারীর এগিয়ে চলার পথ সমৃদ্ধ করতে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। দেশের প্রথাগত আইনে বাল্যবিবাহকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে’ এর সাজা হিসাবে ২ বছরের কারাদন্ড এবং ৫০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান রয়েছে। যেহেতু বেশিরভাগ বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয় গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে তাই এ পরিমাণ দন্ড তাদের জন্য বড় শাস্তি বলেই ধরে নেওয়া যায় কিন্তু এ আইন বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। আইনজীবীদের মতে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে থানায় অভিযোগ কম যার ফলে অপরাধীরা শাস্তি ভোগ করে না, রয়ে যায় আইনের ধরা ছোঁয়ার ত্রি-সীমানার বাহিরে।

অন্যদিকে সুশিক্ষা, নৈতিকতা,মানবিকতার অভাব থাকায় প্রচলিত আইনের চেয়ে গ্রামীণ সালিশকেই বেশি গুরুত্ব দেয় গ্রামের সাধারণ মানুষজন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।

বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে,মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। এজন্য চাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য করতে হবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা। দেশে পূর্বের তুলনায় করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ শতাংশ যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকা, সন্তানের স্কুল খোলার নিশ্চয়তা না থাকা এবং অনিরাপত্তাবোধ থেকে দেশে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের লাগাম টেনে ধরতে হলে চাই সবার সামগ্রিক প্রচেষ্টা, নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি আর আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বাল্যবিবাহ রোধে আইন প্রয়োগ একমাত্র সমাধান হতে পারে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,উপাসনালয়সহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বাল্যবিবাহ রোধকল্পে দেশের শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। এক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন, পরিবারগুলোক যথাযথ কাউন্সেলিং করবেন, উপযুক্ত উপদেশ দিবেন, বাড়িয়ে দিবেন সহায়তার হাত। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে নারীসমাজ।

নারীদের এগিয়ে নিতে সরকারি বেসরকারি ও আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নানা সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে চলছে দেশ কিন্তু করোনাকালে বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়ায় আমরা অনাগত দিনগুলিতে যে প্রজন্ম পাব তা সত্যিকার অর্থেই মহাকালের মহাসংকট সৃষ্টি করবে। করোনা তথা কোভিড-১৯ ভাইরাস যেমন আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ভীষণভাবে ঘায়েল করেছে ঠিক তেমনি বাল্যবিবাহ নামক বিষবৃক্ষ আমাদের কিশোরীদের জীবন নিয়ে রচনা করেছে এক বিদগ্ধ যন্ত্রণাময় উপাখ্যান। বাল্যবিবাহ নামক এই সামাজিক বিষবৃক্ষ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা আর মানুষের বিবেকবোধের জাগ্রতকরণ। যখন সৃষ্টি হবে সামাজিক সচেতনতা, জেগে ওঠবে মানুষের বিবেকবুদ্ধি,বোধশক্তি তখন সমূলে মরে যাবে বাল্যবিবাহ নামক বিষবৃক্ষ। উজ্জল সুন্দর ভবিষ্যত আর সোনালী রূপকথার স্বপ্নমুখর কিশোরীরা হাসিমুখে বই-খাতা হাতে ছুটে চলবে প্রাণের বিদ্যালয়ে জীবনের শিক্ষালয়ে আলোর খুঁজে, স্বপ্নের খুঁজে। যে আলোয় যে স্বপ্নে পথ খুঁজে পাবে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের লাল সবুজের বাংলাদেশ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!