ঢাকা : বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন। কেননা জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বে চরম উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। জলবায়ুর উপাদানগুলোর দীর্ঘমেয়াদি গড় পরিবর্তনই জলবায়ুর পরিবর্তন। মূলত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছর গড় উষ্ণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে পৃথিবী নামক ভূখণ্ডে মানুষের কর্মকাণ্ড। জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বৈরী প্রভাব, এসিড বৃষ্টি, জীবজন্তু ধ্বংসসহ নানারকম সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসানোর ফলে গ্রিনহাউসের প্রভাব, কলকারখানার বর্জ্য, পাহাড় কাটা, প্রযুক্তিগত বর্জ্য অথবা ই-বর্জ্য, অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ানো ইত্যাদি কারণে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিএফসি গ্যাসসহ ক্ষতিকর গ্যাস বাতাসে নিঃসরণ, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন, নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ইত্যাদি কারণে বায়ুর স্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। অপরিনামদর্শী হয়ে মানুষ যখন প্রকৃতির বিপরীতে গিয়ে বিধ্বংসী প্রতিযোগিতায় মগ্ন, তখন প্রকৃতিও তার পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে নানা উপায়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমরা প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, পাহাড়ধস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বজ্রপাত, দাবানলসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সম্প্রতি উত্তর আমেরিকার বরফ ও তুষারপাতের দেশ কানাডায় তীব্র দাবদাহে দেশটির দক্ষিণ ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় প্রায় ২৩০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া গণমাধ্যমের খবরে দেখানো হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ভয়াবহ দাবানলের ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে এবং অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দাবানলে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩-তে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ৬০০-এরও বেশি মানুষ। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মতে, দাবানলে প্রতি মিনিটে অ্যামাজনের প্রায় ১০,০০০ বর্গমিটার এলাকা পুড়ে যাচ্ছে, যা একটি ফুটবল মাঠের প্রায় দ্বিগুণ আয়তনের সমান (একটি ফুটবল মাঠের আয়তন প্রায় ৫ হাজার ৩৫১ বর্গমিটার)। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জুলাইয়ে ৬ হাজার ৮০৩টি দাবানলের ঘটনা দেখা গেছে। অথচ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশেরই উৎপত্তি অ্যামাজনে। গবেষকদের মতে এই বন প্রতিবছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। সে কারণে একে ডাকা হয়ে থাকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হারকে ধীর করতে অ্যামাজনের ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বিশ্বের দীর্ঘতম এ জঙ্গলটির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের প্রায় অর্ধেক। এ ছাড়া সম্প্রতি জাপান ও জার্মানিতে বন্যা, পাহাড়ধস এবং অতিবৃষ্টির ফলে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। সেইসাথে অনেক বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, যানবাহন ভেসে গেছে, ভেঙে গেছে ব্রিজ, অনেক শহর ডুবে গেছে। এতে সহজেই অনুমেয় যে প্রকৃতি তার ধ্বংসলীলা শুরু করে দিয়েছে। এর জন্য দায়ী আমরাই। এর জন্য নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন মাটি, পানি, বায়ুদূষিত করা ইত্যাদি আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডগুলো বেশি দায়ী।
জলবায়ুর এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে আগামী দিনগুলোয় বিশ্বকে মোকাবিলা করতে হবে সংক্রামক-অসংক্রামক বেশ কিছু সমস্যা। খাদ্য সংকট, রোগ-জীবাণুর বৈশ্বিক মহামারী, মেরুতে বরফ গলা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক জগতের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দিনপঞ্জিকায়ও পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন—কিছু কিছু উদ্ভিদের পাতা গজানো, ফুল ফোটা, প্রাণীদের ডিম পাড়া এবং প্রজনন আগে বা পরে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পোকামাকড় ও জীবাণুর বিস্তার এবং সংক্রমণের হার বেড়ে যেতে পারে। যেমন—বর্তমানে গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। গবেষকেরা বলছেন, বনাঞ্চল বিনষ্ট করা ও বন্য প্রাণী শিকারের ফলে প্রাণী ও তাদের বহন করা জীবাণু ক্রমাগতভাবে মানুষ ও গবাদি পশুর সংস্পর্শে চলে আসছে। মহামারি সৃষ্টির মূল কারণ প্রকৃতি ধ্বংসের বিষয়টিকেই উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান-এর এক বিশেষ প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলছেন, বনাঞ্চল বিনষ্ট করা ও বন্য প্রাণী শিকারের ফলে প্রাণী ও তাদের বহন করা জীবাণু ক্রমাগতভাবে মানুষ ও গবাদি পশুর সংস্পর্শে চলে আসছে। নতুন সংক্রামক রোগের প্রায় ৭০ শতাংশ বিভিন্ন প্রাণী থেকে উৎপত্তি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯, সার্স, বার্ড ফ্লু, ইবোলা, এইচআইভি প্রভৃতি।
বর্তমান করোনা মহামারিতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, এই ক্ষতি তার মাত্র ২ শতাংশ। ক্ষতি ঠেকাতে বনাঞ্চল রক্ষা, ঝুঁকিপূর্ণ বন্য প্রাণী ব্যবসা বন্ধ, ফার্মের পশুপাখিকে সংক্রমণ থেকে উন্নত সুরক্ষা, বন্য প্রাণী বাজার এলাকায় দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। কোভিড-১৯ পুরো প্রকৃতি থেকে আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্বনেতারা পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে দূরে রয়েছেন। মহামারি প্রতিরোধ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে কিছু শুনে থাকলেও এর মূল কারণ ঠেকানোর বিষয়ে তাদের কাছ থেকে খুব কম কথা শোনা গেছে। বর্তমানে বিশ্বনেতারা যেসব কথা বলেন, তার বেশিরভাগই স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতি, রক্ষণাবেক্ষণ ও টিকা সংক্রান্ত। কিন্তু এগুলো হচ্ছে রোগ ছড়ানোর পর তা প্রতিরোধের উপায়। কিন্তু আমরা এটা শিখেছি যে, মুক্তির পথ আরো সাশ্রয়ী হতে পারে। মহামারি উৎপত্তির পর তা ব্যবস্থাপনার চেয়ে মহামারি শুরুতেই প্রতিরোধের ব্যয় খুব সামান্য। এসব পদক্ষেপের অধিকাংশই আবার জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংকটের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। কেননা এ সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর সব সম্পদ ফুরিয়ে যাবে। তাই বিশ্বকে সঠিক জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ব্যবহার এবং প্রকৃতির বিপরীতে সকল কর্মকাণ্ড পরিহার করতে হবে। তা না হলে প্রকৃতি যে সময়মত পাল্টা জবাব দিচ্ছে তার মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। তাই কালক্ষেপণ না করে বিশ্বের সকল দেশকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
এ ধরিত্রী আমাদের। সুতরাং এখানে বসবাস করতে হলে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বনাঞ্চল বৃদ্ধির বিকল্প নেই এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। পরিবেশের সরাসরি নেতিবাচক এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে, বিশ্বের সব মানুষ এক হয়ে আমাদের আবাস্থলকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার এখনই সময়।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :