ঢাকা : আঠারো শতকের শুরুতে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতবর্ষের অবদান ২৩ শতাংশ, যা কি না পুরো ইউরোপের সম্মিলিত অর্থনীতির সমান বড় ছিল। ভারতবর্ষের রূপকথার এ অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের হস্তচালিত তাঁতবস্ত্রের কারণে। ভারতীয় উপমহাদেশের হস্তচালিত তাঁতবস্ত্রের চাহিদা পুরো বিশ্বেই সমাদৃত হয়েছিল। আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মিসর, তুরস্ক, পারস্যসহ পাশ্চাত্যবলয়ে ভারতীয় বস্ত্র রপ্তানি হতো। শুধু ১৭৫০ সালেই ভারত উপমহাদেশ থেকে ১৬ মিলিয়ন রুপির বস্ত্র রপ্তানি হয়েছিল। ভারতীয় বস্ত্রশিল্প যখন অধিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা আর ক্রমবর্ধমান রপ্তানির পথে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনি সব বদলে গেল ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম শিল্পবিল্পবের। প্রথম শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বস্ত্র শ্রমিক ভিখারিতে পরিণত হন। ফলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ভাটা পড়ে যায়।
ফটোফিল্ম পণ্যের বিখ্যাত কোম্পানি ইস্টম্যান কোডাক ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিজিটাল ক্যামেরার জন্য ইস্টম্যান কোডাক আজ বিলুপ্ত। ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানির দেড় লক্ষ কর্মী আজ দেউলিয়া। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লবের। বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব, আর ইন্টারনেট, কম্পিউটারের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শিল্পবিল্পের সূচনা ঘটে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস বায়োটেকনোলজির সঙ্গে অটোমশন প্রযুক্তির মিশেলে একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিল্পব। বর্তমান এই একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেটের আবির্ভাব এবং ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহারের ফলে এ ব্যবস্থারই এক অভাবনীয় পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। হাভাস মিডিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট টম গুডউইন পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে বর্ণনা করেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকারি আলীবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রভাইডার এয়ারবিএনবির নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই। ইন্টারনেট প্রযুক্তির এমন চমৎকার সম্মিলনেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলছেন অনেকে।
এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঘনঘটায় শুরু হয়ে গেছে ইন্টারনেট, ইলেকট্রনিকসের সংযুক্তিতার মহাবিপ্লব। নতুন প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জে নতুন উদ্ভাবনে পুরো বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। ব্যাংক বা কাউন্টারে না গিয়েই পেপ্যাল, স্ট্রাইপ, গুগল ওয়ালেটের মাধ্যমে বিল-টিকিটসহ যে কোনো লেনদেন করা যায় নিমিশেই। গুগলহোম, আমাজন অ্যালেক্সা দিয়ে একেকটি বাসা হয়ে যাচ্ছে স্মার্ট হোম। বাড়িতে বাজার না থাকলে বা যে কোনো পণ্যের প্রয়োজন পড়লেই অনলাইন অর্ডারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছে যাচ্ছে বাজার। টেসলা নিয়ে আসছে ইলেকট্রিক গাড়ি। চালকবিহীন গাড়ির জন্য বিপুল বিনিয়োগ করে যাচ্ছে গুগল, অডি, টয়োটা, মার্সিডিজ চেঞ্জ, নিশান, জেনারেল মোটরের মত কোম্পানীগুলো। এ যুগে যুগান্তকারী অবদান রাখবে থ্রি-ডি পণ্য। ইঞ্জিনিয়ার বা ডিজাইনাররা যে কোন স্থানে বসেই কোনো পণ্যের থ্রি-ডি মডেল ফাইল পাঠাতে পারবেন অন্য কোনো অফিসে, যা সেখানে আসল পণ্য বের হয়ে আসবে। বিশ্বের বড় জুতা কোম্পানীগুলো এরেই মধ্যে থ্রি-ডি প্রিন্টেড শু বের করছে। ডিজনি, হুলু, আমাজন প্রাইম, অ্যাপল টিভি সবাই এখন অনলাইনে মুভি-সিরিজ, গান স্ট্রিমিং করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ইউটিউব, স্পাটিফাই, সাউন্ড ক্লাউড, নেটফ্লিক্সের জয়জয়কার এখন। ক্লাউড কম্পিউটিংভিত্তিক ওয়েব সার্ভিস প্ল্যাটফরমের এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্টের কাজ চলছে দুর্বার গতিতে। অচিরেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ন্ত্রণ করবে অ্যাডভারটাইজিং আর এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিকে।
নেটভিত্তিক ইলেকট্রনিকসের যুগান্তকারী এমন উদ্ভাবনে বিশ্ব যেমন এগিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেক মুহূর্তে, ঠিক তেমনি অনেকেই বেকার হয়ে পড়ছেন। ডেলের তথ্যমতে, ২০৩০ সালে এমন সব চাকরি থাকবে যার ৮৫ ভাগেরেই অস্তিত্ব নেই এখন। অনেকেই চাকরি হারাবে অটোমেশনের কারণে। এই ডিজিটাল যুগে কলকারখানগুলোতে ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হবে। আগের শিল্পযুগে দেখা গেছে, মানুষ যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করত; অথচ এখনকার যন্ত্রগুলো অত্যাধুনিক হওয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবে। ফলে অনেকেই বেকার হয়ে পড়বে। উন্নত ধরনের মেশিন, রোবট, ড্রোন, অটোমেশিনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৮-৪৭%, জার্মানিতে ৩৫%, যুক্তরাজ্যে ৩০%, জাপানে ২১% লোকের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশেও পোশাক শিল্পে ৬০%, আসবাবপত্র শিল্পে ৫৫%, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাতে ৪০%, চামড়া ও জুতা শিল্পে ৩৫% এবং পর্যটন ও সেবা শিল্পে ২০% লোক কাজ হারাবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে ৪৭%, বৃহৎ ও মাঝারী শিল্পে ২৫% অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির যুগে একমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগর জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই টিকে থাকবে। তাহলে আমরা কি প্রস্তুত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একজন সংগ্রামী অগ্রনায়ক সহযোদ্ধা হতে? আমরা কি দক্ষতার সাথে চ্যালেঞ্জ করতে পারব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে-কোনো পরিস্থিতিকে? এখনি ভাবার সময়।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
আপনার মতামত লিখুন :