রক্তের অক্ষরে লেখা একুশের লিফলেট

  • দীপংকর গৌতম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০২৫, ০১:১৮ পিএম
রক্তের অক্ষরে লেখা একুশের লিফলেট

ঢাকা : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। যদিও এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পটভূমি রচিত হয়েছিল আরো আগে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান  ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

পাকিস্তানের ছিল পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশ। দুই পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল দুই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। দূরত্ব, ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে শুধু ভৌগোলিক নয়, ভাষা-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন দিক থেকেই অনেক মৌলিক পার্থক্য ছিল। এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান শুরু থেকেই হয়ে উঠেছিল সমগ্র পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি। ফলে তারা তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করত না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার বিষয়টি এই ভূখণ্ডের মানুষ টের পেয়েছিল শুরু থেকেই। কিন্তু মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ অসন্তুষ্টি দেখা দেয় ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একরোখা মনোভাবের কারণে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা প্রশ্নে  বিবৃত করে যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার সমগ্র পাকিস্তানের সব ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ বুঝতে পারে যে, ভাষার আগ্রাসন করে পাকিস্তানি শাসক পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে মাতৃভাষা বাংলার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনো ধরনের আলোচনা করে ঘটনার মীমাংসার দিকে না গিয়ে আন্দোলন দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে। সে অনুযায়ী পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

 ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ায় ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাকে আশ্রয় নেন অনেকেই। বিকেল সোয়া ৩টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে রফিকের মাথার খুলি উড়ে যায়। এরপর আরো

আহত-নিহতের সংবাদ আসতে থাকে। মুহূর্তে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-শিক্ষক-লেখক-সাংবাদিক সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল এই সংগ্রামী প্রহরে। সবার যূথবদ্ধতার কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি হওয়ার তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই একটি লিফলেট প্রকাশিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একটা কিছু করার তাগিদে ওই দিনই সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী, হাসান হাফিজুর রহমান পাটুয়াটুলীর ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিসের বিপরীত গলিতে অবস্থিত পাইওনিয়ার প্রেসে যান। দুটি টেবিলে বসে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা লিখে ফেলেন কয়েকটি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়ে যায় একটি বুলেটিন- ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব।’ এটি সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। বুলেটিনের সঙ্গে সাধারণ জনগণের জন্য একটি লিফলেটও প্রকাশ করা হয়। ওই লিফলেটের লেখক ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। রাতেই লিফলেটটি বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় বিলি করে ভাষা আন্দোলনের কয়েকজন কর্মী।

একুশের প্রথম বুলেটিনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম একজন কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ। তিনি তার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘একুশের প্রথম বুলেটিনটি ডাবল ক্রাউন কাগজে ছাপা হয়। হাসান হাফিজুর রহমান বুলেটিনে লেখা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে যান লিফলেট ছাপা ও বিতরণের জন্য। তার উদ্যোগেই শফিউদ্দিন ক্যাপিটাল প্রেস থেকে ছোট সাইজের প্রথম লিফলেটটি ছাপা হয়। আমীর আলীও হাসানের সঙ্গে চলে যায়। বুলেটিন প্রকাশের আগেই লিফলেটটি ছাপা ও বিলি হয়ে যায়। পাইওনিয়ার প্রেসের মোহাইমেন সাহেব ও তার ছোট ভাই লিফলেট প্রস্তুতকারীদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। প্রেসের ভেতরে একটি বড় টেবিল দিয়ে ও কাগজ দিয়ে আমাদের লেখার সুযোগ করে দেন। তখন একটি লিফলেট করা এত সহজ ছিল না। লেটার প্রিন্টিং প্রেস, তারপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা কাজ কত কঠিন তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। কিন্তু ভাষাসংগ্রামী সেই তরুণরা সব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বুলেটিনের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে লিখে ফেলেন একটি লিফলেট।’ আলাউদ্দীন আল আজাদ তার সাক্ষাৎকারে আরো বলেছিলেন, ‘প্রেসে ম্যাটার তৈরি, প্রুফ দেখা, সব মিলিয়ে তার তর সইছিল না। তিনি বলছিলেন, বানান ভুল হয় হোক, ছেপে ফেলেন। কিন্তু তার পরও ছাপা হয়ে সংগ্রামী সব ছাত্রনেতার হাতে চলে যায় লিফলেট, সেখান থেকে জনগণের হাতে। মানুষ সব লিফলেট লুফে নিয়েছিল। মানুষের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে লিফলেট। জনগণের ভেতরে সঞ্চারিত ক্ষোভের উদগিরণ ঘটিয়েছিল এই লিফলেট। একুশের শহীদদের নিয়ে মানুষ তখন শোকার্ত ও ক্ষিপ্ত। এর মধ্যে এই লিফলেট যেন মানুষকে বারুদের মতো উসকে দিয়েছিল। ফলে আজকের বাস্তবতায় সেই লিফলেটের গুরুত্ব অনন্য। ভাষা সংগ্রামের এ এক অনন্য দলিল।

ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ঋদ্ধ যেসব ঘটনা ভাষা আন্দোলনকে প্রাণ দিয়েছিল, তার মধ্যে সেদিনের লিফলেটটির ভূমিকাও অনন্য। ভাষা শহীদদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে মানুষের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে ওই লিফলেট। চেতনায় ঋদ্ধ সেই লিফলেট আজ মনে হয় শহীদের রক্তের অক্ষরে লেখা। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম সোপান ভাষা আন্দোলন হলে ওই লিফলেটটির ভূমিকাও অনন্য।

এমটিআই

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Link copied!