সাভার : শিক্ষা জীবনে ছাত্রলীগ করার পর প্রায় পাঁচ দশক ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বেনজীর আহমদ। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট করে পরাজিত হন। নৌকার প্রার্থী হিসেবে প্রথম সংসদ সদস্য হন ২০০৮ সালে। এরমধ্যে ২০১৪ সালে ভোট থেকে বিরত ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে জনশক্তি রপ্তানিসহ নানা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট এই নেতার আর্থিক অবস্থা এমপি হওয়ার আগে ছিলো লাখপতি। ছিলো না তেমন জমিজমা। তবে এমপি হয়ে তিনি বনেছেন কোটিপতি। বনে গেছেন কয়েক একর জমির মালিক। বেড়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা।
২০০৮, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে নির্বাচনে অংশ নিতে তার জমা দেওয়া তিনটি হলফনামা থেকে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যখন বেনজীর আহমদ অংশ নেন ওই সময় আহম্মদ এন্টারপ্রাইজ নামে তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো একটি। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আহমদ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি আমদানি রপ্তানি ও কমিশন এজেন্ট ও আহমদ রিয়েল এস্টেট ডেভলপার যুক্ত হয়ে দাঁড়ায় তিনটিতে।
আর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে আরও দুইটি। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই পরিচালিত হয় ঢাকার ঠিকানা থেকে।
লাখপতি থেকে কোটিপতি : ২০০৮ সালে বেনজীর আহমদের নগদ টাকা ছিলো ১ লাখ ৭৫ হাজার আর স্ত্রীর নামে ছিলো ৪ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা। ব্যাংকে জমা টাকা ছিলো ৪ হাজার ৮২ টাকা। ২০১৮ সালে তার ব্যবসার আয় দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৯১ হাজার ৪৭৫ টাকা। আর নির্ভরশীলদের আয় দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩৫ টাকায়। ওই সময় তার নগদ আয় ছিলো ৩ লাখ ৫০ হাজার ৫৯১ টাকা। ব্যবসায় ছিলো ৪২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা আর ব্যবসা বহির্ভূত অর্থ ছিলো ৮৯ লাখ ২৬ হাজার ৩৮১ টাকা।
স্ত্রী ও ছেলের যথাক্রমে আয় হয় ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩০ টাকা ও ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ১৮০ টাকা। ব্যাংকে নিজের নামে ও স্ত্রী নামে জমা ছিলো ৬৮ হাজার ২১৪ টাকা ও তিন লাখ টাকা। নিজের নামে ১২ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও করেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বনে গেছেন কোটিপতি। তার আয়ের বিবরণী বলছে, বর্তমানে তার ব্যবসা থেকে আয় ৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭ টাকা। সংসদ সদস্য ভাতা ও আহমেদ লজিস্টিকস লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে যথাক্রমে ৬ লাখ ৬০ হাজার ও ১২ লাখ টাকা পেয়েছেন। যার মোট অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ৭ টাকা।
স্ত্রী ও ছেলের ব্যবসা থেকে বাৎসরিক আয় যথাক্রমে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
বর্তমানে তার নিজের, স্ত্রী ও ছেলের ব্যাংক জমা আছে যথাক্রমে ১ কোটি ৪ লাখ ৩৯ হাজার ১৯৮ টাকা, ২ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৭ টাকা ও ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ টাকা।
ঋণ বেড়েছে : নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে বেনজির আহমদের ঋণ ছিলো ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৪০ লাখ ১৭ হাজার ৮৪২ টাকা ও ২২ লাখ ৮৫ হাজার ৬২১ টাকা। ২০২৩ সালের হলফনামা মতে, বর্তমানে এই সংসদ সদস্যের ঋণ আছে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে তার ৩ কোটি ৮ লাখ টাকার বেশি দেনা কমেছে।
হয়েছেন অঢেল জমির মালিক : ২০০৮ সালে জমা দেওয়া বেনজির আহমেদের হলফনামার তথ্য বলছে, কৃষি, অ-কৃষি কোনো জমি নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ১৫ লাখ টাকা মূল্যের আড়াই তলা বাড়ি ও ৫৬ শতাংশ জমি ছিলো তার।
২০১৮ সালে ৭৯ লাখ ২০ হাজার টাকা আর্থিক মূল্যের ১৫৫.২৫ শতাংশ কৃষি জমির মালিক হন তিনি। আর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার ২ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার ৫৯০ টাকা মূল্যের ৩৪৪.৭৫ শতাংশ কৃষি জমি আছে।
২০০৮ সালে নিউ ইস্কাটনে দিলু রোডের ১৬/এ ভবনে এক কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার দুইটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন তিনি।
২০১৮ সালের হলফনামার তথ্য বলছে, ২০০৮ সালের সেই অ্যাপার্টমেন্ট দুইটির দাম কমে হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর ২০২৩ সালে এসে ওই অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যমান একই রয়েছে। আর পুরনো দুই আ্যপার্টমেন্ট ছাড়াও ৮ কোটি ৮৬ লাখ ৬৪ হাজার ৩১০ টাকা ও ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় আরও দুইটি আ্যপার্টমেন্টের মালিক ও ১ কোটি ৭২ লাখ ৫ হাজার টাকার দোকানের মালিক হয়েছেন একাদশ জাতীয় সংসদে সদস্য থাকার পাঁচ বছরে।
এছাড়া তিনি ২০১৮ ও ২০২৩ সালে একই মূল্যমান থাকা ৪০ লাখ ২৩ হাজার ২৪০ টাকার ১০ কাঠা জমির মালিক আছেন। আর পৈতৃক সূত্রে আড়াই তলা বাড়ি আছে তার।
স্বর্ণ কমেছে, আসবাবপত্র-ইলেকট্রনিক ও গাড়ি বেড়েছে : ২০০৮ সালে বেনজীর আহমদের স্বর্ণ ছিলো ২০ তোলা। ২০০৮ সালে যার বাজার মূল্য ছিলো ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আর স্ত্রীর ছিলো দেড় লাখ টাকা বাজার মূল্যের ৪৫ তোলা স্বর্ণ। ২০১৮তে স্ত্রীর স্বর্ণের পরিমাণ একই থাকলেও বেনজীরের নিজের স্বর্ণ কমে হয় ১৫ তোলা। আর ২০২৩ সালে স্বর্ণহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। আর স্ত্রীর কাছেও আছে মাত্র ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দুইটি মামলার উল্লেখ থাকলেও প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আর কোনো মামলার বিবরণ নেই এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে।
অপরদিকে ২০০৮ সালের আগে বেনজীর আহমদের বাড়িতে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকার বিভিন্ন আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী ছিলো। ২০১৮তে ছিলো চার লাখ ২০ হাজার টাকার। আর বর্তমানে তার বাসায় আট লাখ টাকার আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী রয়েছে।
২০০৮ সালে কোনো গাড়ির বিবরণ ছিলো না বেনজীর আহমদের হলফনামায়। তবে ২০১৮তে তিনি ৭২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা মূল্যমানের গাড়ির মালিক হন। আর ২০২৩ সালে এসে তিনি এখন আগের মূল্যমানের গাড়ি ছাড়াও আরও এক কোটি ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৫০ টাকা মূল্যমানের গাড়ির মালিক বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
হলফনামায় সংসদ সদস্য হিসেবে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্জন বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন বেনজীর আহমেদ। একাদশ নির্বাচনের ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ যথাক্রমে পাকা সড়ক, রাস্তাঘাট, ব্রিজ নির্মাণে তার অর্জন ৭০% ও ৮০%। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার অর্জন ৭০% ও ৮০%। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্জন ৮০% ও ৯০%। আর সামাজিক-মানবিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের হার ২০০৯ সালে ছিলো ৫০% যা ২০২৩ সালে ৬০% বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-২০ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদসহ ছয়জনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :