ঢাকা : জাতীয় পার্টিতে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়া রওশন এরশাদ তার অনুসারীদেরকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। জাতীয় পার্টিতে মনোনয়ন নিয়ে কী কী হয়েছে, তা নিয়ে তুলে ধরলেন ‘নালিশ’।
রওশন অনুসারীদের ভাষ্য, তারা আওয়ামী লীগ প্রধানকে অনুরোধ করেছেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা করলে আগে তাদেরকে জানানোর জন্য।
মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরের পর ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ এবং আরও কয়েকজনকে গিয়ে গণভবনে যান সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
বৈঠক থেকে বের হয়ে রাঙ্গাঁ সাংবাদিকদের বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা (রওশন) বলেছেন, আমরা যেহেতু তাদের (জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের) সঙ্গে নাই, তারা তাদের মতো নির্বাচন করুক, নির্বাচন উৎসবমুখর হোক। যদি জোট করতে হয়, আমাদের সঙ্গে আলাপ করে করবেন। কারণ আমরা জোটের ভাগিদার।
প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উনি উনার পরিষদ নিয়ে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য অবশ্য আসেনি।
দশম সংসদ নির্বাচন থেকেই রওশন ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে জাতীয় পার্টির দ্যোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন রওশন। সেই নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে প্রার্থিতা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন দলে রওশনকে ঘিরে তৈরি হয় আরও একটি বলয়। তারা জানান, ভোট করবেন।
নির্বাচনের পর থেকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন। বর্তমান সংসদেও তিনি একই পদে আছেন।
তবে ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে যে টানাপড়েন, তাতে এবার বেকায়দায় পড়েছে এরশাদপত্নী। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী রওশন তার নিজের পাশাপাশি সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার জন্য রংপুর-১, ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদের জন্য রংপুর-৩, ময়মনসিংহ জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি কে আর ইসলামের জন্য ময়মনসিংহ-৬, রুস্তম আলী ফরাজীর জন্য পিরোজপুর-৩ সহ কয়েকটি আসন চেয়েছিলেন।
কিন্তু রাঙ্গাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে রাজি নন জি এম কাদের, তার আসনে প্রার্থী করা হয়েছে জি এম কাদেরের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে। জি এম কাদের নিজে দাঁড়িয়েছেন রংপুর-৩ আসনে। এমনকি ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে চার চারবার সংসদ সদস্য রুস্তম ফরাজীকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
জাতীয় পার্টি সাদ এরশাদকে ময়মনসিংহ-৭ আসন দেওয়ার পক্ষে ছিল, যদিও সেই আসনে অন্য একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কে আর ইসলামকে ময়মনসিংহ-৬ আসন দিতে অবশ্য আপত্তি ছিল না। তবে তাকে দুই বছর আগে জি এম কাদের বহিষ্কার করেছেন, সেই আদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে কি না, সেটি ও নিশ্চিত নয়।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর রওশন জানান তিনি ভোটে আসবেন না, তার অনুসারীরাও আসছেন না।
সেই রাতে তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সহযোগিতা না করার কারণে, দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মনোনয়ন প্রদান করা হয়নি। এমতাবস্থায় দলের ও নেতাদের অবমূল্যায়ন করার কারণে নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়।
বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আসন নিয়ে সমঝোতা করলেও এবার এখনও সেই সমঝোতার খবর আসেনি। দুই দল একাধিকবার বৈঠক করলেও আসন নিয়ে আলোচনার কথা অস্বীকার করেছে।
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন রওশন।
রাঙ্গাঁ বলেন, উনাকে (রওশন) তিন চারটা দেওয়া হবে বলেছিল (জাতীয় পার্টির মনোনয়ন), উনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের পত্নী। উনি দল পরিচালনা করেছেন, জেল খেটেছেন আড়াই বছর। সাদ আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, সেও জেলে ছিল আড়াই বছর। এমপি হওয়া… এরশাদ সাহেবের ছেলের সেই অধিকার তো রয়েছে।
সাদ এরশাদ এখন রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য। সেখানে জি এম কাদের ভোটে দাঁড়ানো নিয়ে ক্ষুব্ধ রাঙ্গা বলেন, তিনি (জি এক কাদের) তো চাচা হিসেবে তাকে (সাদ এরশাদ) ভাতিজাই মনে করেন না, সেই সিটে তিনি নিজেই দাঁড়িয়েছেন। সাদের আসনে নিজেই দাঁড়িয়েছেন, এটা তো নেতৃত্বসুলভ আচরণ হলো না।
জি এম কাদের আত্মীয় স্বজনের সম্পর্কে এমনকি তার ভাবীর (রওশন) সম্পর্ক নিয়েও ‘কু মন্তব্য’ করেন বলেও অভিযোগ করেন রাঙ্গা। বলেন, উনার মহাসচিবও (মুজিবুল হক চুন্নু) করেন, আমার সঙ্গেও করেন।
রাঙ্গাঁ বলেন, "উনার (রওশন) এ রকম আরও দলের নেতাকর্মী, আড়াইশ থেকে তিনশর মতো, তাদের বহিষ্কার করেছে এবং মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমার একমাত্র মেয়ে সেখানে (জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে) গিয়েছিল, আমার ভাতিজি গিয়েছিল, মনোনয়ন তো দেয়ইনি, অপমান অপদস্ত করেছে।
সেখানে কো চেয়ারম্যানরা বসা ছিল, তাদের সামনেই করেছে।
রাঙ্গাঁ বলেন, কথা হলো সাদ যদি মনোনয়ন না পায়, রওশন এরশাদ যদি মনোনয়ন না পান, আমি যদি মনোনয়ন না পাই, তাহলে কাদের নিয়ে তারা (জাতীয় পার্টি) নির্বাচনে যাচ্ছে?
রওশনপন্থি নেতাদের মধ্যে কেবল রুহুল আমিন হাওলাদার পটুয়াখালী-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। রংপুর-১ আসন না পেয়ে ক্ষুব্ধ রাঙ্গাঁ সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এই আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনবার জিতেছেন।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :