ঢাকা: বরিশাল মহানগরীর রাজনীতিতে অচেনা মুখ ছিল আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। কিন্তু ২০২৩ সালের বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে খোকনকে প্রার্থী করে চমক দেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
তার মেয়রের মনোনয়ন পাওয়াটা যেমন চমক ছিল, তেমনি মাত্র আট মাসের ক্ষমতায় থেকে দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করে বরিশালবাসীকে চমকে দিয়েছেন। এ সময়েই তিনি নানা বিতর্ক এবং অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। আধিপত্য বিস্তারে বরিশালের একনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র হওয়ার পর বরিশাল সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এবং টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেন। বিভিন্ন স্থাপনা, বাস টার্মিনাল, বালুমহাল, ব্যবসায়িক স্থান ইত্যাদি দখল করেন। বরিশালের বিভিন্ন হাটবাজারের ইজারা বাতিল করার পর সেগুলো তার দলের লোকজনের কাছে তুলে দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে নিয়মিত উৎকোচ আদায় হতো।
এ ছাড়া ছয়তলা বা তার বেশি উচ্চতার ভবনের প্ল্যান অনুমোদনের সময়ও উৎকোচ গ্রহণের ব্যাপারে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদাররা অভিযোগ করলে খোকন সেরনিয়াবাতের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি ওঠে তার দলেই।
বরিশাল সিটি করপোরেশন চলতি বছরের মার্চ মাসে নগরীর সড়ক ও ড্রেন সংস্কারের জন্য ২৬৭ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করে। এই টেন্ডারে বরিশালের বিতর্কিত ঠিকাদার মাহফুজ খানের নামও উঠে আসে। একাধিক ঠিকাদার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানান, এসব প্রকল্পের কাজ ঠিকাদারদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেওয়া হতো এবং এসব কাজের জন্য শতকরা ১০ শতাংশ অগ্রিম টাকা দাবি করা হতো। প্রায় সব ঠিকাদারি কাজে খোকন সেরনিয়াবাতের লোকজন নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজ টাকা নিতেন, যা পৌঁছাত খোকনের হাতে।
বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালেও খোকন তার লোকজন বসান। যেখানে আগে ছিলেন বাসমালিক গ্রুপের সভাপতি আফতাব হোসেন। খোকন তাকে সরিয়ে ছাত্রলীগ নেতা অসীম দেওয়ানকে সেখানে বসিয়ে দেন। স্থানীয় বাজারগুলো থেকে আয় প্রতিদিন তার বাসায় পৌঁছাত।
এ ছাড়া খোকন সেরনিয়াবাতের লোকজন বরিশাল লঞ্চঘাটসহ অন্যান্য নদীবন্দরের ঘাট দখল করে নেন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা জানান, একসময় ঘাটের রাজস্ব আদায় বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। একইভাবে, বরিশালের দুটি বাস টার্মিনাল থেকে প্রতি মাসে ২৫-৩০ লাখ টাকা আদায় করা হতো, যা খোকনকে দিতে হতো। নতুন দূরপাল্লার পরিবহনের আগমনের পরও ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা তার হাতে পৌঁছাত।
এ ছাড়া বরিশাল প্ল্যানেট পার্কের চুক্তি নবায়নকালে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পার্কের পরিচালনা পরিষদের এক সদস্য জানান, চুক্তির নবায়ন এবং সিটি করপোরেশনের ফি ছাড়াও আলাদা ৪০ লাখ টাকা খোকন সেরনিয়াবাতকে দিতে হয়েছিল।
নগর ভবনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, খোকন সেরনিয়াবাত দায়িত্ব নেওয়ার পর বরিশাল নগরীর কোনো ভবন বা স্থাপনা নির্মাণের প্ল্যান অনুমোদন করেননি। কয়েক মাস পর কিছু প্ল্যান অনুমোদন হলেও ছয়তলা বা তার চেয়ে উচ্চভবনের অনুমোদন ক্ষমতা নিজ হাতে রেখে দেন। ছয়তলার নিচের ভবনের অনুমোদনের জন্য উৎকোচ দাবি করা হতো।
নির্বাচনের সময় খোকন বিভিন্ন কর বাতিলের কথা বললেও, দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা খাতে কর বাড়িয়ে দেন। এর ফলে নগরবাসীকে বাড়তি করের বোঝা মাথায় চাপতে হয়। এমনকি ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ২ কোটি টাকার কভিড প্রকল্প চেক স্বাক্ষর করেন, যার বিনিময়ে ২০ লাখ টাকা পার্সেন্টেজ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
পালিয়ে থেকেও বিতর্কে: ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর খোকন সেরনিয়াবাত বরিশাল ছেড়ে পালিয়ে যান, এরপর তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এদিকে, বরিশাল আওয়ামী লীগ নেতারা তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, খোকন সেরনিয়াবাত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়া সরাসরি মেয়র হয়ে ওঠেন, যা বরিশালবাসীর জন্য এক দুঃখজনক ঘটনা।
বরিশালবাসী এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদরা খোকন সেরনিয়াবাতের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য পদক্ষেপ এবং সরকারিপক্ষ থেকে এসব বিষয়ে আরও খতিয়ে দেখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তবে এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য খোকন সেরনিয়াবাতের মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
আত্মগোপনে থেকে মেয়রের স্ত্রীর ফেসবুক পোস্টে তোলপাড়: ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থাকা সাবেক মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের স্ত্রী লুনা আব্দুল্লাহর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বরিশালে তোলপাড় চলছে। গত ২৮ অক্টোবর বরিশাল বিএম কলেজ এবং নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের দুটি পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের রাজপথে নামার আহ্বান জানান।
মাকে হত্যা করে ফ্রিজে রাখে ছেলে, সাজায় ডাকাতির নাটকমাকে হত্যা করে ফ্রিজে রাখে ছেলে, সাজায় ডাকাতির নাটক আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই মন্তব্য করেছেন, লুনা নিজের এই পোস্টের মাধ্যমে নিরীহ ছাত্রলীগ নেতাদের বিপদে ফেলেছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘২০২২ সালে কমিটি অনুমোদনের সময় খোকন অনুসারীরা সাদিক অনুসারীদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু আজ সেসব কমিটির সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করে বিপদের মুখে ফেলেছেন তারা।’
এদিকে, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘খোকন সেরনিয়াবাত বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আকাশে ভাসা একজন ব্যক্তি ছিলেন। যিনি শুধু পরিবারের পরিচয়ে মেয়র হয়েছেন। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় এখন তার ভুলগুলো স্পষ্ট হচ্ছে।’
লুনা আব্দুল্লাহর মন্তব্য এবং পদক্ষেপের ব্যাপারে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম বলেছেন, ‘এটা দুঃখজনক। তারা যদি দলের স্বার্থ বুঝতেন, তবে এমন কিছু করতেন না।’
এআর
আপনার মতামত লিখুন :