রোগীর সেবা : ফজিলত ও আদব

  • সাইফুল্লাহ বিন কাসিম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০২:০৯ পিএম
রোগীর সেবা : ফজিলত ও আদব

ঢাকা : ইসলাম এমন একটি সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা, যার প্রতিটি আদেশ ও নিষেধে মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন কোনো না কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ইসলামের আদেশসূচক প্রতিটি বিধান পালনে সাওয়াব রয়েছে এবং নিষেধসূচক প্রতিটি বিধান হতে বিরত থাকার মধ্যেও রয়েছে পুণ্য। কিন্তু অত্যন্ত আফসোস ও পরিতাপের বিষয় যে, আমরা শুধু ইসলামকে নিদৃষ্ট কিছু বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। বিশেষ বিশেষ কিছু ইবাদত-বন্দেগী করাকে আমরা ইসলাম মনে করি। যেমন শুধু নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ্ব করা, জাকাত দেওয়াকেই আমরা ইবাদত মনে করি। অথচ এগুলো ছাড়াও আরো অনেক মহাপুণ্যের ইবাদত রয়েছে, যেগুলোর প্রতি আমাদের তেমন ভ্রুক্ষেপ ও আগ্রহ নেই; বরং বরাবরের মতো উদাসীনতাই প্রদর্শন করে যাচ্ছি। যেমন ‘ইয়াদাতুল মারিয’ তথা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা-শুশ্রূষা করা। এটা নফল ইবাদতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিশেষ সুন্নাত।

বিশ্বমানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে খুব তাগিদ ও গুরুত্বারোপ করেছেন। নিজেও রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করেছেন এবং উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, এটাও একটি মহান ইবাদত। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা-শুশ্রূষা করা, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার উসিলায় পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধন দৃঢ় হয় এবং পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে আমরা বিমুখ হওয়ার ফলে আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ভ্রাতৃৃত্ব ও ভালোবাসার শীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে অশান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। হাদিস শরিফের সব গ্রন্থে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে বিশদ বিবরণ এসেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা রোগীকে দেখতে যাও এবং জানাযায় অংশগ্রহণ করো। কেননা তা তোমাদেরকে আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১১১৮০)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের পাঁচটি অধিকার রয়েছে। যথা- ১. সালামের জবাব দেওয়া; ২. হাঁচির উত্তর দেওয়া; ৩. দাওয়াত কবুল করা; ৪. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও ৫. জানাযায় অংশগ্রহণ করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১২৪০, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২১৬২) অপর বর্ণনায় রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন,‘কেয়ামতের দিন মহান রাব্বুল আলামিন আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, আপনিতো বিশ্বজাহানের পালনকর্তা, আমি আপনাকে কীভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল; তুমি তাকে দেখতে গেলে তার কাছে আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৫৬৯) অন্যত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা ক্ষুধার্তদের অন্ন দাও, রোগীদের সেবা করো এবং বন্দিদের মুক্ত করে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৬৪৯)

অসুস্থ মুসলিমকে তো তার অধিকার হিসেবে দেখতে যেতে হবে এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষা করতে হবে। সাথে সাথে অমুসলিম অসুস্থ প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকেও দেখতে যেতে হবে এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষা করতে হবে। এটাও একটি ইবাদত এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুমহান আদর্শ। অমুসলিমদের কাছে ইসলামের অনুপম আদর্শ তুলে ধরার এটা একটি দাওয়াতি মাধ্যমও বটে। যে সব অমুসলিম রাসুল (সা.)কে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছিল। তারা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাসুল (সা.) সব ক্রোধ ও ক্ষোভ ভুলে, তাদেরকে দেখতে গিয়েছেন। তাদের খোঁজখবর রেখেছেন। সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। তারা তাঁর এ মহানুভব আদর্শ দেখে ইসলামের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। হজরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন এক ইয়াহুদি যুবক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করত। একদা সে অসুস্থ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) তাকে দেখতে যান। তার মাথার কাছে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তার পিতার দিকে দৃষ্টি ফিরালো। তার পিতা বলল তুমি আবুল কাশেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করো। অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসুল (সা.) সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য, যিনি এই যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন, বলতে বলতে বের হলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৩৫৬, সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩০৯৫)

ফজিলত : রোগীকে দেখতে যাওয়ার অনেক ফজিলতের কথা হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখানে কিঞ্চিত আলোকপাত করার প্রয়াস পাব। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল বেলা কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায় সত্তর হাজার ফেরেশতা বিকাল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর বিকেলে রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয়।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩০৯৮) অন্যত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোগীকে সেবা শুশ্রূষা করতে যায়। আকাশ থেকে একজন ঘোষণাকারী তাকে লক্ষ করে বলেন। তুমি সুখী হও এবং তোমার এই পদচারণা সুখকর হোক। তুমি জান্নাতে নিজ আবাস তৈরি করে নিলে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৪৪৩) রাসুল (সা.) আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোগীকে দেখতে রওয়ানা হলো, সে আল্লাহর রহমতের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকল। যতক্ষণ না সে তথায় গিয়ে বসে। যখন সে গিয়ে বসল তখন সে রহমতের সাগরে ডুব দিল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১৩৬৭৩) অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন কোনো মুসলমান অপর অসুস্থ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায় তখন সে ফিরে আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল বাগানে বিচরণ করতে থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৫৬৮)

রোগীকে দেখার সুন্নাত তরিকা  

১. অজুসহকারে রোগীকে দেখতে যাওয়া। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন। যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সাওয়াবের উদ্দেশে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়; তাকে জাহান্নাম থেকে ষাট বছর সমপথ দূরে রাখা হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩০৯৭)

২. যথাসম্ভব রোগীর শরীরে হাত দিয়ে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিসন নং-২২২৩৬)

৩. রোগীকে সান্ত্বনার বাণী শোনানো। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন। তোমরা যখন কোনো রোগীর কাছে যাবে, তার জীবন সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলবে, তাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাবে, (এ সান্ত্বনার বাণী) ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না, যা ঘটার তাই ঘটবে কিন্তু তার মন সান্ত্বনা লাভ করবে, যা রোগী দেখতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য।’ (সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং-২০৯৪)

৪. রোগীর কাছে বেশি সময় অবস্থান করবে না। কারণ এতে রোগীর কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হ্যাঁ রোগীর কাছে অবস্থান করা, যদি রোগীর অন্তরের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার কারণ হয়। তাহলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাতে কোনো সমস্যা নেই। হজরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রোগী দেখার উত্তম পন্থা হলো-রোগীর কাছ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা।’ (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং-৯২২২)

৫. চিকিৎসক কর্তৃক রোগীর সাথে দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে কোনো পরামর্শ থাকলে তার প্রতি লক্ষ রাখা। অনেক সময় আমরা আবেগতাড়িত হয়ে, এসবের প্রতি তোয়াক্কা না করে, রোগীকে দেখতে যাই। এতে রোগীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।

৬. রোগীর কোনো চাহিদা আছে কি না জিজ্ঞেস করা। খাবার বা অন্য কোনো বৈধ চাহিদা থাকলে যথাসম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করা। রাসুল (সা.) একজন অসুস্থ ব্যক্তির সেবার জন্য তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন। তুমি কি কিছু (খেতে) চাও? সে বলল, আমি কেক খেতে চাই! তিনি বললেন, ঠিক আছে। তখন তারা (সাহাবারা) তার জন্য তা ব্যবস্থা করলেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩৪৪১)

৭. রোগীর কাছে উঁচু আওয়াজে কথা বলবে না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন। সুন্নাত হলো রোগীর পাশে কম বসা এবং বড় আওয়াজে কথা না বলা।’ (মিশকাত, হাদিস নং-১৫৮৯)

৮. রোগীর জন্য দোয়া করা। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন। মুমূর্ষু রোগী ব্যতীত যে কোনো রোগীর কাছে নিচের দোয়াটি সাত বার পাঠ করা হবে। সে রোগী অবশ্যই ওই রোগ থেকে মুক্তি লাভ করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩১০৬)

দোয়া : ‘আস আলুল্লাহাল আজীম রাব্বাল আরশীল আজীম আইয়াশফিয়াকা’।

৯. রোগীর কাছে নিজের জন্য দোয়া চাওয়া। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন। তোমরা যখন কোনো রোগীকে দেখতে যাবে। তার কাছে দোয়া চাইবে, কারণ তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো কবুল হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৪৪১)

১০. রোগী মুমূর্ষু হলে তার কাছে সুরা ইয়াসিন পাঠ করা। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা মুমূর্ষু রোগীর কাছে সুরা ইয়াসিন পাঠ করো।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩১২১)

১১. অসুস্থ ব্যক্তিকে রোগের অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস না করা। কারণ অনেক সময় এতে রোগী বিব্রতবোধ করে। তবে চিকিৎসকের ব্যাপার ভিন্ন। আল্লাহতায়ালা আমাকে, আপনাকে উল্লিখিত বিষয়াবলির ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : মুহাদ্দিস, আল-জামিয়াতুল আজিজিয়া দারুল-উলুম আল ইসলামিয়া, দৌলতখান, ভোলা

 

Link copied!