ঢাকা : বিশ্ব মুসলিমের নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও মহাআনন্দের উৎসব হিসাবে প্রতিবছর সাড়ম্বরে পালিত হয় ঈদুল আজহা। ঈদ অর্থ খুশি। এ শব্দটি শুনলেই মনে হয় চারপাশে শুধু খুশি আর হাসি, শুধু আনন্দ আর উল্লাস। কিন্তু শুধু খুশিতে মেতে ওঠা আর উল্লসিত হওয়াই ঈদের প্রকৃত সার্থকতা নয়। বছর শেষে ঈদ আসে শুধু ভালো ভালো খাবার খাওয়া, দামি দামি কাপড় পরিধান করা আর বিত্তশালী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে বল্গাহীন আনন্দ-উল্লাস আর যা খুশি তাই করে বেড়ানোর নাম ঈদ নয়। ঈদ আসে ধনি-গরিব, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো সবার মধ্যে আনন্দ-ভালোবাসা বিলানোর জন্য। নিজের খাবার থেকে ক্ষুধার্তকে ভাগ দেওয়ার জন্য। পথের ভুখা-নাঙ্গা ফকির ইয়াতিম মিসকিনকে ঘরে ডেকে এনে ভাই বলে সম্বোধন করে আদর আপ্যায়ন করানোর জন্য। ঈদ উৎসব শুধু বিত্তবানদের জন্য নয়, তা সর্বান্তকরণে অনুধাবন করে ঈদের আনন্দ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ভাগাভাগি করে দেওয়ার জন্যই ঈদ।
মহাকবি কায়কোবাদ (কাজেম আল কুরাইশি কায়কোবাদ) তাঁর ‘অশ্রুমালা’ কাব্যগ্রন্থে ‘ঈদ আবাহন’ কবিতায় ঈদ উপলক্ষে কামনা করেছেন জাগৃতি : ‘আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনঃপ্রাণ; জাগায়ে মোশ্লেমে সবে গাহ আজি মিলনের গান। ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিষ্মান রবি; জীবন সার্থক হবে, ধন্য হবে এ দরিদ্র কবি।’
ঈদ বছরে দুইবার আসে। শাওয়াল মাসে আসে ঈদুল ফিতর, আর জিলহজ মাসে আসে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ পরম ত্যাগের নিদর্শনস্বরূপ জিলহজ মাসের ঐতিহাসিক ১০ তারিখ মহাসমারোহে পশু জবেহের মাধ্যমে কোরবানির যে আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকেন, তা-ই ঈদুল আজহা। বস্তুতঃ হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন করতে প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাইল (আ.)কে কোরবানি করার মতো যে ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করে গেছেন, সে সুন্নাত পালনার্থে মুসলিম জাতি আজো কোরবানি করে থাকে। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ বিশ্ব মুসলিম ঈদগাহে জমায়েত হয়ে দুই রাকাআত ঈদুল আজহার ওয়াজিব নামাজ আদায় করে থাকেন। সালাত শেষে ঈমাম সাহেব দুটি খুৎবা দিয়ে থাকেন। খুৎবা মনোযোগের সঙ্গে শোনা ওয়াজিব।
ঈদুল আজহার দিনের সুন্নতসমূহ : (১) খুব প্রত্যুষে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (২) উত্তমরূপে মিসওয়াক করা। (৩) সকাল সকাল উত্তমরূপে গোসল সম্পন্ন করা। (৪) সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা ও চোখে সুরমা লাগানো। (৫) সাধ্যমতো নতুন, পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা। (৬) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রত্যুষে ঈদগাহে গমন করা। (৭) সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের বন্দোবস্ত করা ও আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, ইয়াতিম-মিস্কিন, গরিব-দুঃখিকে পানাহার করানো। (৮) ঈদগাহে গমন করার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা। (৯) ঈদুল আজহার পূর্বে ৯ জিলহজ হতে ঈদের পর ১৩ জিলহজ পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজ আদায়ের পর উচ্চৈঃস্বরে উপরিউক্ত তাক্বিরে তাশরিক পাঠ করা। (১০) ঈদগাহে এক পথ দিয়ে গমন করা এবং নামাজ শেষে অন্য পথে ফিরে আসা। (১১) যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। (১২) ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় না করে ঈদগাহে আদায় করা উত্তম। (১৩) ঈদগাহে যাওয়ার পথে তাক্বিরে তাশরিক- আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার ওয়া লিল্লাহিল হামদ (মহান আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ জন্য সকল প্রশংসা) উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করতে করতে যাওয়া। (১৪) দুপুর পর্যন্ত অন্য কোনো খাবার গ্রহণ না করে কোরবানির গোশত দিয়ে আহার করা মুস্তাহাব। (১৫) ঈদের নামাজ সকাল সকাল আদায় করে যথাসম্ভব প্রথম প্রহরেই কোরবানি করা উচিত। (১৬) ঈদুল আজহার খুৎবায় কোরবানির বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।
ঈদুল আজহার সালাত শেষে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কোরবানি করা ওয়াজিব। সর্বোত্তম পন্থা হলো কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া, নিজের পরিবারবর্গকে খাওয়ানো, আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দেওয়া এবং গরিব-মিসকিনকে দান করা। গোশত বিতরণের মুস্তাহাব তরিকা হলো সমস্ত গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজনের মাঝে এবং আরেক ভাগ গরিব-মিস্কিনদের মাঝে বিতরণ করা। এভাবে ঈদের খুশিতে সবাইকে শরিক করতে পারলে নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হবে। ঈদের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭ সংখ্যায় তার ‘ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন,
‘মুসলেমের আজ ঈদ শুভময় আজ মিলনের দিন গলায় গলায় মাখামাখি আমির ফকির হীন। আজ সবারি হস্ত পূত ধোওয়া স্বরগ নীরে তাই তো চুমোর ভিড় লেগেছে নম্র নত শিরে।’
ঈদুল আজহার নামাজের পূর্বে কোরবানি করা দুরস্ত নয়। নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ করা মুস্তাহাব। যদি নিজে জবেহ করতে না পারে তবে অন্যের দ্বারা জবেহ করালে দোষের কিছু নেই। এমতাবস্থায় কোরবানি দাতা নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম। জবেহ করার সময় কোরবানির পশু কিবলামুখি করে শোয়ানো জরুরি। ইচ্ছাকৃত বিস্মিল্লাহ পরিত্যাগ করলে জবেহকৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি ভুলক্রমে বিস্মিল্লাহ ছেড়ে দেয় তাহলে তা খাওয়া জায়িজ আছে। (হিদায়া, খ- ৪, পৃ. ৪৩৫) কোরবানির সময় মুখে নিয়্যত করা জরুরি নয়। অবশ্য মনে মনে নিয়্যত করতে হবে যে, আমি শুধুমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার উদ্দেশে কোরবানি করছি। তবে মুখে দুআ পড়া উত্তম। আর জবেহ করার পূর্বে ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়া তথা ধারালো অস্ত্র দ্বারা কোরবানি করা মুস্তাহাব। (শামী, খ- ৫, পৃ. ২৭২)
কয়েক ব্যক্তি একসঙ্গে শরিক হয়ে যদি একটি গরু কোরবানি করে তবে মাপযন্ত্র (দাড়িপাল্লা) দিয়ে মেপে সমানভাবে গোশত বণ্টন করা উচিত। অনুমান করে বণ্টন করা জায়িজ নেই। কেননা ভাগের কমবেশী হলে তা সুদ বলে গণ্য হবে এবং গুনাহগার হতে হবে। কোরবানির গোশত অমুসলিমকে দেওয়াও জায়িজ। কিন্তু মজুরি বাবদ দেওয়া জায়েজ নেই। অবশ্য মুসলিমকে দেওয়াই উত্তম। কোরবানির গোশত কোরবানি দাতার জন্য বিক্রি করা মাকরুহে তাহরিমী। যদি কেউ বিক্রি করে তাহলে ইহার মূল্য সাদকা (দান) করা ওয়াজিব। কসাইকে গোশত বানানোর মজুরিস্বরূপ গোশত, চামড়া, রশি প্রভৃতি প্রদান করা জায়িজ নেই। পারিশ্রমিক দিতে হলে অন্যভাবে অন্য খাত হতে তা প্রদান করতে হবে। (শামী, খ- ৫, পৃ. ৪৭৮)
গরু, মহিষ বা উটের মধ্যে কয়েক ব্যক্তি শরিক থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে গোশত ভাগ করে নেওয়ার পরিবর্তে যদি সমস্ত গোশত একত্রে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে অথবা রান্না করে তাদের খাওয়ায় তবে ইহাও জায়েজ। কিন্তু শরিকদের কোনো একজন ভিন্নমত প্রকাশ করলে জায়িজ হবে না। কোরবানির গোশত তিনদিনের বেশি সময় জমা করে রাখা জায়িজ তবে দীর্ঘদিন জমা করে রাখা দুরস্ত নয়। কোরবানির পশুর রশিও সাদকাহ করা মুস্তাহাব। (মাসাইলে ঈদাইন, পৃ. ১৮৩)
কোরবানির চামড়া দান করা উত্তম। আর বিক্রি করলে তার মূল্য গরিব-মিস্কিনদেরকে দান করতে হবে। চামড়ার বিক্রিত অর্থ নিজে খরচ করে যদি অন্য অর্থ দান করে তবে আদায় হবে তবে মাকরুহ হবে। কোরবানির চামড়ার মূল্য মাদ্রাসা, মসজিদ মেরামত কাজে অথবা মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন প্রমুখের বেতন হিসাবে প্রদান করা জায়েজ নেই। কোরবানির পশু জবেহর পর চামড়া ছাড়ানো, গোশত কাটা ইত্যাদি কারণে যথোচিত মূল্যের কমে কসাইর নিকট চামড়া বিক্রয় করাও দুরস্ত নয়। (মাসাইলে ঈদাইন, পৃষ্ঠা ১৯২)
বিখ্যাত হাদিস সংকলন আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি কোরবানি করার ইচ্ছা রাখে তার জন্য মুস্তাহাব হলো জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটা নখ না কাটা। আর যার কোরবানি করার সামর্থ্য নেই, তার জন্য উত্তম হলো কোরবানির পরিবর্তে চুল ও নখ কাটা। ‘হিদায়া’ গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের ৪৩৪ নং পৃষ্ঠায় বর্ণনা করা হয়েছে, কোরবানির পূর্বে কোরবানির পশুর দ্বারা কোনো কাজ করে নেওয়া, যেমন হাল চাষ করা, তার ওপর আরোহণ করা, দুগ্ধ দোহন করে পান করা কিংবা কোরবানির জন্তুর পশম কেটে বিক্রয় করা মাকরূহ।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলিম জাতির কোরবানি-উৎসর্গ-বিসর্জনের দিন, অথচ এ দিনই আবার প্রকৃত ঈদের আনন্দ-উৎসবের দিন। ত্যাগেই সুখ, ভোগে নয়; বিসর্জনেই প্রতিষ্ঠা, উৎসর্গেই সাফল্য, নিবেদনেই আনন্দ। সারা জাহানের প্রতিটি মুসলমান যদি জীবনের পদে পদে এমনই করে কোরবানি করে; এমনি করে আল্লাহর রাহে আপন স্বত্বাকে বিলিয়ে দেয় তাহলে ত্যাগের মধ্যে আনন্দ, মৃত্যুর মধ্যে জীবন খুঁজে নেওয়া মোটেও দুঃসাধ্য হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস এবং এখানেই ঈদ উৎসবের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও বিসিএস (সা. শি) ক্যাডার কর্মকর্তা।
আপনার মতামত লিখুন :