ঢাকা : অর্থনীতি মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। মহান আল্লাহ কোরআনে অর্থনীতির মৌলিক নীতিমালা বলে দিয়েছেন। এই নীতিমালা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত করা সম্ভব।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এই নীতিমালার ভিত্তিতে মদিনায় যে আদর্শ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা স্বল্প সময়েই দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দূর করেছিল। কোরআনে বর্ণিত তেমনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শিক্ষা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
এক. ‘এমন যেন না হয়, তোমাদের সম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে।’ (সুরা হাশর ৭) মুফাসসিররা এই আয়াতের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, ‘এটি কোরআনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি, যেখানে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্দেশনাটি হলো, সম্পদের প্রবাহ যেন সমগ্র সমাজের ভেতরে সমভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এমন কোনো পরিস্থিতি যেন না সৃষ্টি হয়, যেখানে সম্পদ কেবল বিত্তবানদের মধ্যেই ঘুরপাক খায়, ধনীরা আরও ধনী হয়ে ওঠে, আর গরিবরা আরও দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে যায়।’ (তাফসিরে সামআনি ৫/৪০০)
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অসামঞ্জস্য : কোরআনের এই মূলনীতি থেকে বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি অজ্ঞ।
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যে, অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে সব ধরনের সম্পদ ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত করা। এই ব্যবস্থায় সম্পদের প্রবাহ কখনোই দরিদ্র বা বঞ্চিত শ্রেণির দিকে যায় না; বরং তা বরাবরই ধনী ও পুঁজিপতিদের দিকে ধাবিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তাদের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো সুদভিত্তিক অর্থনীতি।
এর মাধ্যমে গরিব, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত উপার্জন ধনী সুদখোরদের ভান্ডারে জমা হয়। তদুপরি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গৃহীত নীতিমালাগুলোও মূলত পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই প্রণয়ন করা হয়। ফলে সম্পদের প্রবাহ কখনোই প্রাকৃতিক ভারসাম্যে পরিচালিত হতে পারে না। এটি সমাজে অসাম্য বাড়িয়ে তোলে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়।
এ ছাড়া কিছু গোষ্ঠী ও দল নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুললেও তারা সম্পদের ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের চরমপন্থা অবলম্বন করে থাকে। এমন ব্যবস্থায় ধনী ও গরিব উভয়কে ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সম্পদকে একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত করা হয়।
ইসলামের সমাধান : কোরআন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর ও নির্দেশনামূলক ভাষায় একটি নীতিমালা পেশ করেছে। যার মাধ্যমে সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়েছে এবং একটি দৃঢ় জাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেটার মূল লক্ষ্য হলো আর্থিকভাবে দরিদ্র ও বঞ্চিত শ্রেণির কাছে সম্পদের প্রবাহ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি দান-খয়রাত, সদকা ও কাফফারা দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যা এই সমস্যার একটি সমাধান হিসেবে কাজ করে।
উত্তরাধিকার আইনের মাধ্যমে সম্পদের একচেটিয়া একত্রীকরণ হ্রাস করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এর পাশাপাশি এমন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে এবং এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, কৃষক ও বিনিয়োগকারীদের বৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম, শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষিকাজে উৎসাহিত করে। এতে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। কোরআনের এই নীতিমালায় অসাধারণ ভারসাম্য ও মিতব্যয়িতা পরিলক্ষিত হয়, যা মানবজীবনের অর্থনৈতিক দিকগুলোকে ন্যায় ও সমতা দ্বারা পরিচালিত করে।
দুই. ‘তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক।’ (সুরা জারিয়াত ১৯) এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলা হয়েছে। সাধারণত মানুষ মনে করে যে, তার কাছে যে ধন-সম্পদ আছে, তা তার একান্ত ব্যক্তিগত, সেই সম্পদ থেকে সে যেকোনো সময় যেভাবে ইচ্ছা দান-খয়রাত করতে পারে এবং তা ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হয়।
কিন্তু কোরআন এখানে এক আশ্চর্য কথা বলেছে যে, ধনী ব্যক্তির সম্পত্তিতে দরিদ্র ও নিঃস্বদের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ যারা সরাসরি সাহায্য চায় তাদের অধিকার রয়েছে। আর তাদেরও অধিকার রয়েছে যারা দরিদ্র তো বটে, কিন্তু নিজেদের আত্মমর্যাদার কারণে তাদের অভাবের কথা প্রকাশ করতে পারে না।
ধনী ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলা হচ্ছে যে, আপনি যাদের সাহায্য করছেন, তাদের ওপর আপনি কোনো ধরনের অনুগ্রহ করছেন না, বরং এটি তাদের অধিকার যা আপনি তাদের দিয়েছেন। এভাবে দরিদ্রদের সম্মান ও আত্মমর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখা হচ্ছে।
আল্লাহতায়ালা পুরো দুনিয়ার মালিক, তিনি আপনার সম্পত্তি অন্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন, যা আপনি তাদের দিচ্ছেন। তাই এটি আপনার কোনো বিশেষ দান নয়, বরং এটি তাদের অধিকার, যা আপনি তাদের প্রদান করছেন। এই কারণে সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার মনোবল বড় হওয়া উচিত এবং আপনাকে অনুগ্রহ বা অহংকার বোধ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
আধুনিক যুগে কোরআনের এই আয়াতের তাৎপর্য অনেক বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা বা এনজিওগুলো একদিকে প্রচারের মাধ্যমে সাহায্য প্রদান করে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের নিজস্ব মতাদর্শের প্রচার ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, যা সমাজে নতুন জটিলতা তৈরি করে। তাই যদি ধনীদের সম্পত্তিতে দরিদ্রদের অধিকার স্বীকৃত হয়, তবে অনেক বড় সমস্যা নিজ থেকেই সমাধান হয়ে যাবে।
তিন. ‘লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে) তারা কী ব্যয় করবে? আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত।’ (সুরা বাকারা ২১৯) প্রথমত এটি একটি সরল উপদেশ। মানুষ জানতে চেয়েছিল, আল্লাহর পথে কতটুকু দান করা উচিত।
কোরআন অত্যন্ত সহজভাবে উত্তর দিয়েছে, যা তোমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে বেঁচে যায়, তা আল্লাহর পথে দান করো। তবে এই ছোট্ট উত্তরেই আধুনিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। আজকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষকে সঞ্চয় করতে উৎসাহিত করা হয় অর্থাৎ তারা নিজেদের আয়ের একটি অংশ জমিয়ে রাখে। এর ফলে অর্থ বাজারে প্রবেশ করে না এবং নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকে। যদি সেই অর্থ ব্যাংকে জমা করা হয়, তবে ব্যাংক অনেক সময় ইচ্ছামতো ঋণ দেয়, যা প্রায়শই আর্থিক উন্নয়নে সহায়ক হয় না। কিন্তু কোরআনের এই নির্দেশ অর্থ প্রচলনের ওপর গুরুত্বারোপ করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা সঞ্চিত থাকে, তা আল্লাহর পথে ব্যয় করা।
অর্থাৎ যদি মূলধন বা অর্থ বাজারে সক্রিয় থাকে, তবে তা লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্যের উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যখন এই মূলধন বা অর্থ বাজারে প্রবেশ করে, তখন এর মাধ্যমে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হয়। এই চাহিদার ভিত্তিতে শিল্পপতিরা পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারে সরবরাহ করে। এই চাহিদা ও সরবরাহের শৃঙ্খল অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আসে, মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং সমাজে সমৃদ্ধি ও কল্যাণের বার্তা পৌঁছায়।
কোরআন মানুষকে কৃপণতা ও অপচয় উভয় থেকেই বিরত থাকতে বলে এবং তাদের মধ্যপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দেয়। এটি সম্পদ ও উপকরণের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করে এবং নির্দেশ দেয় যে, আল্লাহ যে নিদর্শনগুলো দিয়েছেন এবং যে সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, সেগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে, যাতে সমাজের সাধারণ মানুষ উপকৃত হতে পারে।
কোরআনের এই তিনটি সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা মেনে চললে মানবজীবনে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হবে। প্রথম নির্দেশনার আলোকে এমন নীতি ও ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব, যা মূলধনের প্রবাহ দরিদ্র ও বঞ্চিতদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করবে।
দ্বিতীয় নিদর্শনাতে ধনী ব্যক্তিদের প্রতি একটি উদার আহ্বান জানানো হয়েছে, তারা যেন নিজেদের ধন-সম্পত্তিতে দরিদ্রদের অধিকারকে আন্তরিকভাবে স্বীকার করে এবং স্বেচ্ছায় তাদের প্রাপ্য প্রদান করে।
তৃতীয় নির্দেশনা হলো, উদ্বৃত্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা। এটি মূলধনকে শ্রম, ভূমি ও ব্যবস্থাপনার মতো অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে একত্রিত করে নতুন উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :