ঢাকা : সৌরজগতের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে মানুষের জল্পনাকল্পনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর ঘাঁটি হচ্ছে নাসা (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সংস্থা, যা বিমানচালনাবিদ্যা ও সৌরজগৎ সম্পর্কিত গবেষণা করে থাকে। ১৯৫৮ সালের ২৯ জুলাই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
নাসার সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত। নাসার রয়েছে নয়টি কেন্দ্র, জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি এবং সাতটি পরীক্ষা ও গবেষণা সুবিধা। নাসায় স্থায়ী এবং অস্থায়ী হিসেবে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজারেরও বেশি লোক কাজ করেন। এর মধ্যে এশিয়ানদের সংখ্যা ৬ শতাংশেরও বেশি।
নাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ মহাকাশ অনুসন্ধানের নেতৃত্বে নাসা ভূমিকা পালন করে; যার মধ্যে অ্যাপোলো মুন ল্যান্ডিং মিশন, স্কাইল্যাব স্পেস স্টেশন এবং স্পেস শাটল মিশন ছিল। নাসা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের উন্নয়নে সহযোগিতা করছে এবং ওরিয়ন স্পেসক্রাফট, স্পেস লঞ্চ সিস্টেমের বিকাশে তদারকি করছে। এজেন্সি লঞ্চ সার্ভিস প্রোগ্রামের জন্যও নাসা কাজ করে যাচ্ছে।
নাসার প্রশাসক মার্কিন সিনেট অনুমোদনের সাপেক্ষে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বর্তমানে বিল নেলসন জো বাইডেনের অধীনে নাসার প্রশাসক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। আর নাসার প্রধান নভোচারী হিসেবে আছেন জোসেফ এম আকাবা।
আনন্দের খবর হলো চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশে আসছেন জোসেফ এম আকাবা। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দেশের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমের সাথে মতবিনিময়ের জন্য ঢাকায় পা রাখবেন তিনি।
আকাবার এই সফর এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কারণ এটি নাসার প্রধান নভোচারীর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর। তার এই সফরের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনাপর্ব অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে তিনি তাদের মহাকাশ বিজ্ঞান, রোবোটিক্স এবং স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি,প্রকৌশল, গণিত ) শিক্ষায় ক্যারিয়ার গড়তে অনুপ্রাণিত করবেন। আকাবা মহাকাশ অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবেন।
প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ছাড়াও, আকাবা একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে তিনি বৈশ্বিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নাসার অবদান এবং মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করবেন। বিশেষ করে, আর্টেমিস অ্যাকর্ডস-এর মাধ্যমে সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরবেন।
আর্টেমিস অ্যাকর্ডস মহাকাশে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য নীতিমালা প্রচার করে, যা নাসা এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতের মধ্যে আরও সহযোগিতা জোরদার করতে সাহায্য করবে।
এদিকে নাসার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বহু আগে থেকেই। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ১৯৮২-তে পাশ করা বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আতিকুজ্জামান নাসার সঙ্গে কাজ করছেন মহাশূন্যের সঙ্গে ইন্টারনেট কমিউনিকেশন নিয়ে। তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
সম্প্রতি নাসার গবেষণা দল ইটা কারিনার মতো আরাধ্য পাঁচটি বিশাল নক্ষত্র খুঁজে পেয়েছেন, যা অবস্থান করছে মিল্কিওয়ের বাইরের গ্যালাক্সিগুলোয়। আর সেই গবেষণা দলের (মেরিল্যান্ডের গডার্ড স্পেস ফ্লাইট) নেতৃত্বে ছিলেন এবং এখনো আছেন বাংলাদেশের ছেলে ড. রুবাব ইমরাজ খান। ২০০৪ সালে তিনি অ্যাস্ট্রোফিজিকসে পড়াশোনার জন্য কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি পান। ২০০৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ২০১৪ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন।
নাসার সেরা উদ্ভাবনী পুরস্কার-২০১৭ জিতে নাসার বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাহমুদা সুলতানা। মহাকাশে সহজে ব্যবহার করা যাবে, এমন ছোট ও যুগান্তকারী প্রযুক্তি যন্ত্র আবিষ্কারের জন্যই এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ন্যানো টেকনোলজি, থ্রিডি প্রিন্টিং, ডিটেক্টর ডেভেলপমেন্ট নিয়েই মাহমুদার গবেষণা। এমআইটিতে কোয়ান্টাম ডট প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন আলো তরঙ্গ ডিটেক্টর নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। এখানে পিএইচডি চলাকালীন তার বানানো সেন্সর প্ল্যাটফরম নিয়ে এক জব ফেয়ারে তিনি নাসায় কাজের সুযোগ পান ২০১০ সালে।
এছাড়া নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে (এমসিসি) সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করছেন সিলেটের মাহজাবীন। মিশিগানের ওয়েইন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি।
নাসায় আবহাওয়া বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করছেন সুনামগঞ্জের ড. ফাহাদ আল আবদুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করে ফাহাদ নাসার গ্লোবাল মডেল অ্যান্ড স্যাটেলাইট ডেটা অ্যাসিমিলেশন অফিসে কাজ শুরু করবেন।
নীলফামারীর ছেলে এরশাদ কবির চয়ন (২৯) নাসার আরলিংটন ভার্জিনিয়ায় তথ্য প্রকৌশলী (ডেটা ইঞ্জিনিয়ার) হিসাবে চাকরি করছেন। তিনি ২০২০ সালে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে তথ্যবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
এখানেই শেষ নয়, ‘পৃথিবী থেকে ২০২৫ সালে প্রথমবারের মতো মঙ্গল গ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য নির্বাচিত সেরা চারজন সৌভাগ্যবান মানব-মানবীর মধ্যে বাংলাদেশি নারী মহাকাশচারী বিজ্ঞানী লুলু ফেরদৌস (৩৫) একজন। তিনি বর্তমানে নাসাতে সহযোগী গবেষক হিসাবে কর্মরত আছেন।
নাসায় সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মশিউর রহমান। নাসার ডিপ স্পেস কমিউনিকেশনস বিজ্ঞানী ড. মশিউর রহমান বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ারলেস কমিউনিকেশন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে আসছেন। তার ওয়ারলেস প্রযুক্তির ওপর রয়েছে বিভিন্ন গবেষণা ও উদ্ভাবন। ইতোমধ্যে ১০০’র বেশি পেটেন্ট তৈরি করেছেন তিনি।
মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানোর গবেষণায় গবেষক দলে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ গবেষক নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার মো. তারিকুজ্জামান। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ‘লা টেক বায়োমাস’ দল মহাকাশে উদ্ভিদ জন্মানোর অনন্য উপায় নিয়ে গবেষণা করছে। এ গবেষণার জন্য নির্বাচিত ৪ জনের মধ্যে একজন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার মোহাম্মদ তারিকুজ্জামান।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মহাকাশ ও নভোমণ্ডল নিয়ে খুবই আগ্রহী। তারা মহাকাশ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ডেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করছে, তৈরি করছে নানা অ্যাপস ও টুলস। নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবার এই সফর মহাকাশ সম্পর্কে বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি উৎসাহী করে তুলবে।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :