ঢাকা : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুবেলা খেয়ে জীবনধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিগত সরকারের সময় থেকে বাড়তে থাকা দ্রব্যমূল্য এখন যেন আরও তেতে উঠেছে। চালের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
এ ছাড়া পেঁয়াজ, ডিম, আলু এবং সবজির বাজার এখনো বেশ চড়া। এ পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তরা দীর্ঘদিন ধরেই লাইন দিচ্ছে ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএস) দোকানে। দিন দিন এ লাইন আরও বড় হচ্ছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের আওতায় সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতিদিন এক টন চাল ও দুই টন আটা বিক্রি করছেন ওএমএসের ডিলাররা। যেখানে ৩০ টাকা হারে ১৫০ টাকায় পাঁচ কেজি মোটা জাতের চাল ও ২৪ টাকা হারে ১২০ টাকায় পাঁচ কেজি আটা পাচ্ছেন ক্রেতারা, যা বাজারমূল্য থেকে প্রতি কেজি চালে ৩০ ও প্রতি কেজি আটায় ২৬ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।
তবে চাহিদা বাড়ায় অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে বলে জানান ডিলাররা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রতি শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে ওএমএসের কর্মসূচি। সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় প্রতিদিন এক টন চাল ও দুই টন আটা বিক্রি চলমান থাকে। কিন্তু কয়েক মাস ধরেই ওএমএসের ট্রাকসেলে মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু সীমাবদ্ধতা থাকায় ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যেক মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওএমএসের লাইনও দীর্ঘ হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তদের ভিড় বাড়ছে দিন দিন।
রামপুরা বাজারের ওএমএসের ডিলার রুহুল আমিন বলেন, ‘মানুষ খুব কষ্টে রয়েছেন। আগে ট্রাক থেকে চাল-আটা নিম্নআয়ের মানুষ কিনতেন। এখন মধ্য আয়ের মানুষদেরও দেখা যায়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন এক টন চাল ও দুই টন আটা বিক্রি করি আমরা। যারা সিরিয়ালে সামনে দাঁড়ান, তারা মাল কিনতে পারছেন। আর যারা শেষের দিকে থাকেন, তাদের অনেকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।’
আটা থেকে চালের চাহিদা বেশি দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষ আটার পরিবর্তে চাল নিতে চান। কিন্তু নিয়ম থাকায় আমরা কারও কাছে শুধু চাল বিক্রি করি না। তাই অনেককে দেখা যায়, আটার পরিবর্তে চাল নিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে কিছুটা অতিরিক্ত টাকাও গুনতে হচ্ছে।’
গত বৃহস্পতি ও রবিবার রামপুরা টিভি সেন্টার, ফকিরাপুল গরমপানির গলি ও পরীবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওএমএসের ট্রাক থেকে কম দামে চাল ও আটা কিনতে গাদাগাদি করে মানুষ দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়েছেন। খুব ভোরে যারা সারির প্রথম দিকে দাঁড়াতে পেরেছেন, তারাই আটা ও চাল কিনতে পারছেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. রাকিব মৃধা। তার পরিবারের সদস্য চারজন। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বাজারে সব পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়েছে। ২২ হাজার টাকা বেতনে দুই বাচ্চার পড়ার খচর, বাড়িভাড়া ও পরিবারের খরচ মেটানো কষ্টকর হয়ে উঠছে। কখনো ভাবিনি ওএমএসের লাইনে এসে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু বাধ্য হয়ে লোকলজ্জা ভেঙে এখানে দাঁড়িয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে যে বেতনে চাকরিতে যোগদান করেছি, এখনো সেই বেতন পাচ্ছি। অথচ চাকরিতে যোগদানের সময় বলা হয়েছিল প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট হবে। কোম্পানি তার কথা না রাখলেও বাজার ঠিকই আমাদের খরচ বাড়িয়েছে। অন্য কোথাও যাওয়ার রাস্তা নেই।’
এটি শুধু রাকিব মৃধার একার গল্প নয়। গত কয়েক বছরে মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে দ্রুতগতিতে। দিন দিন খরচের গতি বাড়ছে।
পঞ্চাশোর্ধ্ব মনু মিয়া ফকিরাপুল গরমপানির গলিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাপ, কী করার আছে? চলার জন্য মানুষ অনেক পথ বেছে নেয়। ভ্যান চালিয়ে সংসারটা চালাই। সবসময় কাজ থাকে না। মাসের শুরুতে ভালো কাজ থাকলেও শেষে এসে তা কমে যায়। তাছাড়া ঢাকায় একটা সিট নিয়ে থাকতে ২ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা লাগে। তার ওপর বাইরে খাবার খেতে গেলে প্রতিবেলা ন্যূনতম ৬০ থেকে ৭০ টাকা লাগে। তাই কিছুটা খরচ কমাতে ও বাড়ির জন্য এখান থেকে চাল-আটা কিনছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজার থেকে একই চাল কিনলে প্রতি কেজিতে ৩০ ও আটায় ২৬ টাকা বেশি দেওয়া লাগে। তাই কষ্ট করে খুব বেয়ান্না বেলায় আইয়া লাইনে খাড়াইলে কিছুটা মাল পাওয়া যায়। যার থেকে আমি কিছুটা খাই আর কিছুটা বাড়িতে বউ-পোলাপাইনের জন্য পাঠাই।’
এদিকে সরকার চালের দাম সহনীয় ও বাজার সচল রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর চাল আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমদানি শুল্ক ১৫ এবং রেগুলেটরি শুল্ক ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ চাল আমদানিতে বিদ্যমান করহার ২৫ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে (অগ্রিম আয়কর) নামিয়ে আনা হয়েছিল। সরকারের এসব উদ্যোগ যেন কোনো কাজেই আসছে না। উল্টো পাগলা ঘোড়ার দৌড়ে চালের দাম বাড়ছে।
রাজধানীর খোলাবাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়, যা চলতি বছরের জানুয়ারিতেও বিক্রি হয়েছিল ৪৮ টাকায়। মোটা চাল ছাড়াও প্রতি কেজি দেশীয় বাসমতীর কেজি ৯০-৯৫, কাটারি (সিদ্ধ) ও কাটারি নাজির ৭২-৭৮ এবং বিভিন্ন ধরনের জিরাশাইল (মিনিকেট) ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। মাঝারি চাল ৫৮-৬৩ টাকা। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৮ টাকা। সরু চালের সর্বনিম্ন দর ৮ টাকা বেড়ে ৭২ টাকা হয়েছে।
টিসিবি আরও বলছে, গত ৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম কেজিতে ২ টাকা, মাঝারি চাল ৪ এবং সরু চালের দাম ১২ টাকা বেড়েছে।
এদিকে বাজারে বোতলজাত তেলের সরবরাহ কমেছে। বিশেষ করে সরকারের শুল্ক কমানোর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছে না ভোক্তা। বরং বোতলজাত তেলের সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি দেখা গেছে। বিশেষ করে এক ও দুই লিটারের বোতল সয়াবিন দেখা যায়নি বেশিরভাগ দোকানে। পাঁচ লিটারের বোতল থাকলেও দাম নিচ্ছে গায়ের দরে অর্থাৎ ৮১৮ টাকা। সপ্তাহ দুয়েক আগে কেনা যেত ৭৯০ থেকে ৮১০ টাকায়। তবে খোলা সয়াবিন ও পামওয়েলের সরবরাহ স্বাভাবিক। পামওয়েলের দর লিটারে ১০ টাকার মতো কমেছে। প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকার আশপাশের দরে। খোলা সয়াবিনের লিটার কিনতে খরচ হবে ১৬৫ থেকে ১৬৭ টাকা।
গত এক সপ্তাহে আলুর দামে সে পরিবর্তন দেখা যায়নি। উল্টো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি নতুন আলু মানভেদে ৯০ থেকে ১১০ টাকা এবং পুরনো আলুর কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে বিক্রি হওয়া নতুন আলু ভারত থেকে আমদানি করা। স্থানীয় আলু ক্ষেত থেকে ওঠার আগপর্যন্ত দর কমার সুযোগ সীমিত।
অন্যদিকে বাজারে শীতের সবজিতে সরবরাহ বাড়লেও দামের চড়া ভাব যায়নি এখন। প্রতি কেজি গোল বেগুন ৭০ থেকে ১০০, লম্বা বেগুন ৬০ থেকে ৭০, মানভেদে শিম ৫০ থেকে ৮০, পটোল ৫০ থেকে ৬০, ঢেঁড়স ৬০ থেকে ৭০, উচ্ছে (ছোট জাত) ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি পিচ ফুলকপি আকারভেদে ৩০ থেকে ৫০, লাউর পিস ৬০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। মানভেদে কাঁচা মরিচের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১৪০ টাকা।
অপরিবর্তিত রয়েছে ডিম ও মুরগির দাম। আগের মতোই ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ এবং সোনালি জাতের মুরগি ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের ডিমের ডজন বড় বাজারে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হলেও মহল্লার দোকানিরা রাখছেন ১৫০ টাকা। এ ছাড়া গরুর মাংসের কেজি ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজারেও বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, শুল্ক ছাড় দেওয়ার কারণে সরকারের রাজস্ব আয় কমবে। কিন্তু এর সুফল মানুষ পাচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে সরকারকে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, শুল্কছাড়ের সুযোগ আমদানিকারকদের পেটে গেছে। সাধারণ ক্রেতা বঞ্চিত থেকেছেন। এজন্য বাজার তদারকি ও পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর প্রতি জোর দেন তিনি। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :