স্বাধীনতা জাদুঘর এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৫, ১২:৩৩ পিএম
স্বাধীনতা জাদুঘর এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ

ঢাকা : মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ছবির ফ্রেমের ভাঙা কাচের টুকরো। কোথাও আবার আগুনে পুড়ে খসে পড়া পলেস্তরা; সেই সঙ্গে তীব্র পোড়া গন্ধ। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। পুরো ভবন জুড়ে ভৌতিক অন্ধকার। এ দৃশ্য ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘরের।

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে–এ কথা বলে প্রথমে ভেতরে ঢুকতে দিতে বাধা দিলেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঢুকে মনে হল–না ঢুকলেই বোধ হয় ভালো হত। জাদুঘরের অবস্থান ভূগর্ভে, ফলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরের চিত্র।

ভবনের ভেতরে ভাঙচুর করা নিদর্শন পড়ে আছে; কোথাও আবার পুড়িয়ে দেওয়া আলোকচিত্রের অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে মেঝেতে। একটি গ্যালারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত ট্যাংকের অংশও মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল। ভবনের ভেতরে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। ছিল, এখন নেই : মুঘল শাসনামল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বিজয় দিবস পর্যন্ত নানা ঘটনার বর্ণনাখচিত আলোকচিত্র আর নানা নিদর্শন-স্মারক ছিল স্বাধীনতা জাদুঘরে।

১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই উদ্যানেই দিয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর এই উদ্যানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।

২০১৫ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের ৪৪তম স্বাধীনতা দিবসে এ জাদুঘর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের এখতিয়ারে একটি শাখা জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হয় স্বাধীনতা জাদুঘর।

এ জাদুঘর মূলত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে একটি বৃহৎ পরিকল্পিত নকশার অংশ। এই নকশায় রয়েছে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, তিনটি জলাধার, ‘শিখা চিরন্তন’, স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্রবিশিষ্ট একটি ম্যুরাল এবং ১৫৫ আসন বিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়াম।

তবে পুরো নকশার প্রধান বিষয় হল একটি ৫০ মিটার বিশিষ্ট আলোক স্তম্ভ, যা ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। স্তম্ভটি কাচের প্যানেল দিয়ে নির্মিত। এই স্তম্ভের নিচেই স্বাধীনতা জাদুঘর।

স্বাধীনতা জাদুঘর বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। জাদুঘর প্লাজা ৫ হাজার ৬৬৯ বর্গমিটার টাইলস দিয়ে আবৃত। এই প্লাজা চত্বরের পূর্ব পাশের দেয়ালে টেরাকোটা ম্যুরালের অংশবিশেষও নষ্ট করা হয়েছে।

জলাধারের উপরে একটি ফোয়ারা রয়েছে, যাতে উপর থেকে পানি পড়ত। এই ফোয়ারার চারপাশের মার্বেল পাথর তুলে ফেলা হয়েছে।

বাংলাদেশি স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম ১৯৯৭ সালে একটি জাতীয় স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতা জয়ের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজের দায়িত্ব পান। ৬৭ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত পুরো প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা।

এই জাদুঘরে ১৪৪টি কাচের প্যানেলে তিনশর বেশি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র ছিল। ছিল টেরাকোটা, যুদ্ধের ঘটনা সংবলিত সংবাদপত্রের কাটিং। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিলিপি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে প্রচারের জন্য তৈরি করা বিভিন্ন পোস্টারও জাদুঘরে ছিল।

বৃত্তকার একটি ঘরের মাঝখানে ফোকর দিয়ে অবিরাম পানি পড়ত, যা লাখো শহীদের মা এবং নির্যাতনের শিকার নারীদের অশ্রুকে নির্দেশ করে। ‘অশ্রুপাত’ নামে এ ফোয়ারা এখন বন্ধ।

এর বাইরে বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং স্থাপনার চিত্র ছিল এখানে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যে টেবিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন, তার একটি রেপ্লিকা ছিল জাদুঘরে। ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কামানের অংশসহ বেশ কিছু নিদর্শন। তবে এখন সেসব ধ্বংসস্তূপ।

ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যসহ আর কিছু নিদর্শন, যার কিছুই অক্ষত নেই এখন।

কী ঘটেছিল?

জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের সহকারী কিপার মো. গোলাম কাউছার স্বাধীনতা জাদুঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৫ অগাস্ট একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এখানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ৫ তারিখ এ ঘটনার বিষয়ে আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ আছে, মামলা আছে। শুধু অফিস চালু রাখার জন্য এখন খোলা-বন্ধ রাখা হয়। না হয় এতদিনে সাপ-বিচ্ছু বাসা বাঁধত।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘শিখা চিরন্তন’ এলাকায় শনিবার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন আনসার সদস্য হায়াত আলী। জাদুঘর খোলা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন, “জাদুঘর বন্ধ। ৫ অগাস্ট আমরা ছিলাম না। সেদিনই ভাঙচুর করা হয়েছিল, পরে এসে আমরা দেখেছি।

জাতীয় জাদুঘরের নিরাপত্তাকর্মী মাফিউর রহমান মাহি বললেন, জাদুঘর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন আমরা শুধু দায়িত্বে আছি, যাতে ভেতরে অন্য কেউ ঢুকতে না পারে। অনেকেই আসেন, জানতে চান ভেতরে ঢোকা যাবে কি না। আমরা ‘না’ করি।

জাদুঘরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য শামীমও বললেন একই কথা। জানালেন, ৫ অগাস্ট ভাঙচুর করার পর লুটপাটও চালানো হয় এখানে। তবে কারা ভাঙচুর আর লুটপাট করেছে, তিনি তা স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না।

লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক সালেক খোকন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ রাষ্ট্রের একটি মীমাংসিত সত্য। সেটাতে আসলে হাত দেওয়া উচিত নয়। করলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমার চরিত্রটা কি দাঁড়াবে এটি একটি বড় প্রশ্ন। আমাদের এই ঐতিহাসিক সত্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

তিনি বলেন, ইতিহাস আসলে কখনো পরিবর্তন করা যায় না। কাকে কতটুকু সম্মান দেবেন, সেটা দৃষ্টিভঙ্গি আর উদারতার ব্যাপার। এই সময় এসে এই প্রজন্মের কাছে আসলে আপনি কিছু লুকাতে পারবেন না। প্রকৃত ইতিহাস তারা খুঁজে বের করবেই। স্বাধীনতা জাদুঘর যে ভাঙা হয়েছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, মর্মান্তিক।

পরিকল্পনা আছে, তবে শিগগির চালুর আশা নেই : জাতীয় জাদুঘরের অধীনে পরিচালিত হয় স্বাধীনতা জাদুঘর। সেটি আবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

স্বাধীনতা জাদুঘর নিয়ে পরিকল্পনা জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সারয়ার ফারুকী ‘ব্যস্ত’ আছেন জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

মূলত স্বাধীনতা জাদুঘরসহ সেখানকার পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তবে দেশের সব জাদুঘর পরিচালিত হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই।

উপদেষ্টার পরামর্শ মেনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের পরিচালক প্রনব কুমার সাহাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আব্দুল মোক্তাদের বলেন, পরিকল্পনা আছে। এটা নিয়ে সরেজমিন তদন্ত হয়েছে। তদন্তের পর ক্ষয়ক্ষতিও নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। এটা চলমান রয়েছে।

কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বা কী পরিকল্পনা আছে সে বিষয়ে বিশদ জানতে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

জাদুঘরটি ফের চালুর পরিকল্পনা আছে বললেও কবে চালু হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারেননি জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক নাফরিজা শ্যামা। তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগের অতিরিক্ত সচিব।

স্বাধীনতা জাদুঘর কবে নাগাদ চালু হতে পারে বা সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা হয়েছে কি না এ প্রশ্নের জবাবে জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি মেরিনা তাবাসসুম বলেন, আমাদের পর্ষদ তো গঠিত হয়েছে বেশি দিন হয়নি। আমরা সবগুলো জাদুঘরই দেখছি। অবশ্যই এটা দেখে ঠিকঠাক করতে হবে। এটা করার প্রয়োজন আছে অবশ্যই। এভাবে তো ফেলে রাখা যাবে না।

মেরিনা তাবাসসুম স্বাধীনতা জাদুঘরের দুই স্থপতির একজন। তিনি বলেন, এটা আমাদের পরিকল্পনায় আছে। এটার মেনটেইনেন্সেরও কিছু বিষয়ও আছে। ঈদের পরে পর্ষদের মিটিং আছে। আমরা সেখানে যাব। দেখব যে কীভাবে এটাকে আবার সুন্দরভাবে গুছিয়ে চালু করা যায়।

তবে স্বাধীনতা জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা মো. গোলাম কাউছারের ভাষ্য, শিগগির এ জাদুঘর চালু করা সম্ভব হবে না।

এটা যেহেতু ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, এখানে বিদ্যুৎ না থাকলে কোনো কার্যক্রম সম্ভব হবে না। বিদ্যুতের লাইন পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। এই সংযোগ ঠিক করার জন্য যদি সরকার বরাদ্দও দেয়, তাহলে দরপত্র আহ্বান করে কাজ শুরু করতেও অন্তত তিন মাস সময় লাগবে।

এরপর চালু করলে দর্শনার্থীদের জন্য নিদর্শন রাখা লাগবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সব সিদ্ধান্ত নেবে। সব মিলিয়ে আরও সময় লাগবে। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Link copied!