স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবহেলা

টিকা কূটনীতিতে বিপাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়!

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২১, ১১:৩৪ এএম
টিকা কূটনীতিতে বিপাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়!

ঢাকা : বাংলাদেশের ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তি হলেও ভ্যাকসিন দিতে পারেনি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। বরং টিকা রপ্তানিই বন্ধ করে দিয়েছে ভারত।

শেষে দ্বিতীয় ডোজের জন্য ঘাটতি ১৬ লাখ টিকার জন্য বারবার অনুরোধ করে এবং কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি মেটাতে যুক্তরাজ্যের কাছে অনুরোধ জানিয়েও সুখবর মেলেনি। এখন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দ্বিতীয় ডোজের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। কিন্তু কোথাও কোনো সুখবর নেই। অথচ ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর ১৭ কোটিই এখনো টিকার বাইরে।

কীভাবে তাদের টিকার জোগান আসবে, এ নিয়ে চাপে রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসিতে হিমশিম খাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দেশের টিকা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ সংকট আখ্যা দিয়ে বলেছেন, টিকা পেতে আমরা মরিয়া। কারণ, ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ রাখায় বাংলাদেশ ১২ সপ্তাহের মধ্যে ১৬ লাখ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে ব্যর্থ হবে। আমরা টিকার বিষয়ে ভারতকে চিঠি দিয়েছি।

তবে এর আগে ভারত এক চিঠিতে বাংলাদেশকে জানায়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে কোনো টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী অক্টোবরের আগে ভারত টিকা রপ্তানি করবে না।

এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি মেটাতে আমরা ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্য, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জরুরি ভিত্তিতে ১৬ লাখ টিকা চেয়েছি। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কিছু টিকা দিতে রাজি হলেও তাতে জটিলতা আছে।

কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ অন্যান্য উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সেখান থেকে মেলেনি কোনো সুখবর। বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ টিকার দেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা দিতে দেরি হলে করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, দেশে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে। এছাড়া চীনের সিনোফার্ম টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে কমিটি সুপারিশ করে। একইসঙ্গে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বন্ধ রাখার জন্যও সুপারিশ করে।

কিন্তু টিকা সংকট পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে টিকা পেতে বাংলাদেশ যোগাযোগ শুরু করে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে। টিকা চাওয়া হয় যুক্তরাজ্য ও কানাডার কাছেও। কিন্তু আশ্বাস মিললেও কোনো জায়গা থেকেই দ্রুত টিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা পায়নি বাংলাদেশ।

কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চিঠি দিলেও টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকায় নেই বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের টিকা পেতে জটিলতা আছে। জটিলতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এই অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমোদন দিতে অনেক সময় নিচ্ছে।

তবে যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছে, তাই এফডিএ এটি অনুমোদন না করলেও যুক্তরাষ্ট্র যদি টিকার চালান পাঠাতে রাজি হয়, বাংলাদেশ অবিলম্বে তা নিতে রাজি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার প্রায় ৬ কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে কানাডার কাছেও আবেদন করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার বেনোয়া প্রেফেঁতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশকে ২০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কানাডার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো ভারত থেকে টিকা না পাওয়ায় ‘গণটিকাদান কার্যক্রম’ স্থগিত আছে। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢুকে পড়ায় দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। কিন্তু সংকটে নেই টিকার মজুত। তাই জরুরি ভিত্তিতে চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা আমদানি করে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা থাকলেও তা সহসাই পাওয়ার আশা নেই। কূটনীতিক সূত্রগুলো জানায়, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর চীনের টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় টিকা পেতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।

রাষ্ট্রদূত জানান, চীনের টিকা কিনতে অনেক দেশ অর্ডার দিয়ে রেখেছে। এখন বাংলাদেশকে টিকা পেতে হলে ওইসব দেশের পরে নিতে হবে। তবে প্রথম দফায় ৫ লাখ এবং দ্বিতীয় দফায় আরো ৬ লাখ টিকা উপহার হিসেবে পাচ্ছে বাংলাদেশ। তাতে কী আর ১৭ কোটি মানুষের ৩৪ কোটি ডোজের চাহিদা মিটবে?

কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়ার টিকা পেতেও সময় লাগবে। কারণ রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকার উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অব রাশিয়ান ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (সিআরডিআইএফ) এর পক্ষ থেকে চুক্তির শর্ত সংবলিত যে খসড়া দেওয়া হয়েছিল, তার উত্তর দিতেও দেরি করেছে বাংলাদেশ। গত ৯ মে ঢাকা-মস্কো চুক্তির খসড়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের ২৯ সুপারিশ পাঠানো হয়। রাশিয়ায় বাংলাদেশ মিশন সেটি সিআরডিআইএফ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমির কারণেই চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা আসতে দেরি হচ্ছে। তিনি জানান, এসব দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব। কিন্তু  টিকার বিষয়ে অন্যান্য সব বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব কাজে দেরি করেছে।

এছাড়া চুক্তির চাইনিজ ভাষার খসড়ায় সই করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য বেইজিংয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হতাশাও জানিয়েছে। কারণ, কাগজপত্র চূড়ান্ত না হলে প্রক্রিয়া শেষ হবে না। মন্ত্রী জানান, রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোনও করেছেন, টেক্সটও করেছেন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব, মুখ্য সচিবকে জানিয়ে দিয়েছি, তাগাদা করার জন্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে মস্কো যে বিষয়গুলো পছন্দ করে না, সেই কাজগুলো করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

তিনি বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে কিছু ডকুমেন্ট সই হয়েছে এবং কিছু হয়নি। শুরুতে টিকার একটি সংখ্যা বলা হয়েছিল এবং পরে আবারো সংখ্যা বদল করা হলো। রাশিয়ানরা এটি পছন্দ করে না। এগুলো নিয়ে আমরা ব্যস্ততায় আছি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!