ঢিলেঢালা লকডাউন, ঝুঁকি বাড়ছে সীমান্তে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২১, ০৪:০৮ পিএম
ঢিলেঢালা লকডাউন, ঝুঁকি বাড়ছে সীমান্তে

ঢাকা : করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায় সম্পূর্ণ ও সাতটি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেয়া হয়েছে। তবে প্রথমদিন কিছুটা কড়াকড়ি হলেও এরপর থেকেই লকডাউন চলছে ঢিলেঢালাভাবে। সাধারণ মানুষ বিধি-নিষেধ মানছেন না। পথেঘাটে জনসমাগম হচ্ছে। লকডাউন কার্যকর করার ব্যাপারে প্রশাসনও তেমনভাবে সক্রিয় নয়। এর ফলে বড় ধরনের সংক্রমণ ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে সীমান্ত এলাকায়।   

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহ ধরে করোনায় মৃত্যু বেড়েছে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেও মৃত্যু বাড়ছে। বিভাগওয়ারি হিসাবে মৃত্যু বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহীতে। আগের সপ্তাহের তুলনায় রাজশাহীতে মৃত্যু বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। মৃত্যু বাড়ার হারে দ্বিতীয় স্থানে আছে খুলনা বিভাগ। এখানে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ৪২ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে সংক্রমণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।        

গত ২৫ মে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন চলছে। এর মধ্যেও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার (৪ জুন) সংক্রমণের হার ছিল ৫৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের দিনের গড় হার ছিল ৪১ দশমিক ৬০ শতাংশ। অথচ শনিবার (৫ জুন) চলমান লকডাউনে শহরের নিমতলা মোড়, বড় ইন্দারা মোড়, পুরাতন বাজার মোড়, ডাকঘর ও থানার সামনে মানুষ ও যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি।

সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরায় লকডাউনের প্রথম দিন (৫ জুন) বেশ কড়াকড়ি ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন (৬ জুন) পরিস্থিতি শিথিল হয়ে যায়। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়াত জানান, পরীক্ষা অনুযায়ী আক্রান্তের হার ৪৭.৩৪ শতাংশ।

এছাড়া জেলায় ২৪ ঘণ্টায় করোনা উপসর্গ নিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ২২০ জন। করোনা আক্রান্ত হয়ে সাতক্ষীরায় ২৪৫ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ও কোয়ারেন্টিন সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।  

সংক্রমণের বড় সন্দেহ বর্ডার দিয়ে যাতায়াত। উচ্চ সংক্রমণশীল এলাকার পাশে থাকলে সংক্রমণ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এটা সংক্রমণের একটা প্রচলিত নিয়ম। দেশে গত ৮ মে প্রথম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়।

সরকারি গবেষণায়, দেশে করোনার ৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোর মধ্যে ৪০টি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) পাওয়া গেছে। সরকারের এই গবেষণাতে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় ধরনের সামাজিক সংক্রমণেরও (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভারতীয় ভ্যারিয়্যন্ট নিয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হলো এর মাধ্যমে রোগটি দ্রুত ছড়ায়। মৃত্যুও বেশি হয় এবং চিকিৎসাও কাজ করে তুলনামূলক কম।

গত মে মাসে পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর থেকে দেশে করোনা সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। ভারতে সংক্রমণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার সময়ই বিশেষজ্ঞরা সীমান্ত বন্ধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। প্রথম দিকে সরকার বিষয়টি তেমন আমলে নেয়নি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশ কিছু নাগরিকের করোনা ধরা পড়ার পরই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন স্তরে সমন্বয়হীনতা প্রমাণ করে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই ‘লকডাউন’ কিংবা ‘বিধিনিষেধ’ সংক্রান্ত পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এ কারণে শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে ওই বিধিনিষেধের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। লকডাউন কার্যকর হয়নি দেশের কোনো অঞ্চলেই।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ৬ এপ্রিল থেকে সারাদেশে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তা প্রথম দিন থেকেই ঢিলেঢালা ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা ওই ব্যবস্থাকে ‘বিধিনিষেধ’ বলা হলেও সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী একে ‘লকডাউন’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু শুরু থেকে কোথাও লকডাউনের লেশমাত্র ছিল না।

প্রশ্ন উঠেছে, সরকার কেন বিধিনিষেধগুলো কার্যকর করতে পারল না? তবে বিশেষজ্ঞরা বিধিনিষেধ কার্যকর করতে না পারার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছেন। সরকারি বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেয়া করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের যানবাহন সরবরাহ করেনি। এতে করে দুর্ভোগে পড়েন চাকরিজীবীরা।

আবার বাস মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা মনে করেছিলেন, গত বছরের মতো দীর্ঘ সময় ধরে পরিবহন বন্ধ থাকবে। এজন্য তারাও সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে চাইছিলেন না। আবার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সড়কে শত শত প্রাইভেট কার চলেছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।

অনেকে বলেছেন, গরিব আটকে রেখে ধনীদের চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় গত ৬ মে থেকে গণপরিবহন চালু করা হয়। এরপর রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয় যানজট। সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ সবকিছু ভেঙে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক। কিছু খোলা আবার কিছু বন্ধ রেখে তো লকডাউন হয় না। লকডাউন হলো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া।

অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের বাইরে অন্যদের সাথে কোনো ধরনের দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। সবকিছু বন্ধ থাকবে। এ অবস্থা থাকলে মানুষ উদাহরণ দেখিয়ে অজুহাত খুঁজত না। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। একটি পর্যায়ে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।

সুতরাং যে উদ্দেশ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তা হোঁচট খেয়েছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় আর সরকারি অন্যান্য কার্যক্রম এক ধারায় চলে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে তারপরই এসব নির্দেশনা জারি করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়েছিল কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির সাথে যুক্তদের কাছে জানতে চাওয়া প্রয়োজন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নতুন করে তারা কী করবেন?’  

দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সংক্রমণ বৃদ্ধির উদ্বেগজনক খবর আসছে। ইতিমধ্যে সেখানে সংক্রমণ বাড়ার সাথে সাথে হাসপাতালে শয্যা ও অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৫০ বেডের জেলা সদর হাসপাতালে ২০ বেডের কোভিড ইউনিট থাকলেও কোনো আইসিইউ নেই। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আইসিইউ সাপোর্টের জন্য নিয়ে যেতে হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। একই অবস্থা অন্য জেলা হাসপাতালগুলোতেও। এক্ষেত্রে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন স্থানীয়রা। এসব অঞ্চলে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থাও বাড়ানো দরকার।

এ প্রসঙ্গে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন ‘নমুনা পরীক্ষার জন্য এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার সময় চলে এসেছে এবং একই সাথে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে কিনা সেজন্য জেনোম সিকোয়েন্সিংও জরুরি হয়ে পড়েছে।’  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে; যেভাবে নতুন ধরনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে ও ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সংক্রমণ-প্রবণ সব এলাকায় সর্বাত্মক লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে লকডাউন ঘোষণা করে বসে থাকলেই হবে না, তা কার্যকর করার আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। লকডাউন সফল করার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো জনগণকে সম্পৃক্ত করা, প্রান্তিক আয়ের মানুষদের সরকার কর্তৃক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি যারা সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।   

দেশে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। ভাইরাসটির সংক্রমণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণার অভাবে অনেক মানুষ সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সরকারের উচিত সীমান্তের জেলাগুলোর সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা এবং সংক্রমণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।   

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!