ক্যাডার কর্মকর্তাদের খবরদারি চান না চিকিৎসকরা

অসন্তোষ বাড়ছে স্বাস্থ্য প্রশাসনে

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১২, ২০২১, ০৫:৩৭ পিএম
অসন্তোষ বাড়ছে স্বাস্থ্য প্রশাসনে

ঢাকা : স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসন ও চিকিৎসকদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দিনদিন জটিল হচ্ছে। এখাতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের খবরদারি চান না চিকিৎসকরা।

সমপ্রতি স্বাস্থ্যের বড় পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রাখা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের উপেক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন চিকিৎসক নেতারা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর এমনকি স্বাস্থ্য খাতের যে কোনো প্রকল্প ও সিদ্ধান্তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়োগ চান তারা। সমস্যার সমাধান না হলে শিগগির কঠোর আন্দোলনের ঘোষণাও দেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে কাঠামোগত সংস্কারের সময় এসেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যবস্থাপনা দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর স্বাস্থ্য খাত চলতে পারে না। সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও প্রশাসনকে পৃথক করে কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই তাদের স্বাস্থ্য প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে সরাতে হবে।

কারণ হাসপাতালে কী পরিমাণ ওষুধ ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন এ সম্পর্কে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকলে কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়মের সম্ভবনা বেশি। সেজন্য সেবা খাতে প্রশাসনের তুলনায় চিকিৎসকদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।

এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম কমে আনা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক, স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ স্বাস্থ্য খাত অধিদপ্তরগুলোর নিয়োগে কাঠামোগত সংস্কার করা না হলে চিকিৎসা ও প্রশাসন কর্মকর্তাদের মুখোমুখি অবস্থান অব্যাহত থাকবে। এর জেরে প্রাপ্য স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ।

স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসন ক্যাডার নিয়োগে চিকিৎসক নেতাদের বিরোধিতার বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিয়োগ দিয়ে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। তবে যেসব চিকিৎসক নেতাদের স্বার্থে আঘাত লাগছে তারা প্রশাসন ক্যাডার নিয়োগে ক্ষেপেছেন।

অন্যদিকে চিকিৎসকদের দাবি, স্বাস্থ্য প্রশাসন যারা চালাবেন তাদের স্বাস্থ্য বিভাগ বোঝার দক্ষতা থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যাদের হাতে স্বাস্থ্য প্রশাসন তারা স্বাস্থ্য বিভাগ সম্পর্কে তেমন দক্ষতা নেই। এজন্য স্বাস্থ্য প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন চায় চিকিৎসক নেতারা। দীর্ঘদিনের এই দাবি ফের জোরালো হচ্ছে।

এদিকে দেশে সরকারি ৩০টি মেডিকেল কলেজ ও একটি ডেন্টাল কলেজ ও আটটি ইউনিট রয়েছে। রাজধানীর বাইরে প্রতিটি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক সংকট রয়েছে।

বিশেষ করে সাতক্ষীরা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, রাঙামাটি, নোয়াখালীসহ নতুন কয়েকটি মেডিকেল কলেজে ভয়াবহ শিক্ষক সংকট রয়েছে। এসব মেডিকেল কলেজে পাঠদানের জন্য শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ফিজিওলজি, অ্যানাটমিসহ মৌলিক বিষয়গুলো পড়ানোর শিক্ষক নেই।

এছাড়া কয়েকটি মেডিকেল কলেজে একজনও অধ্যাপক নেই। কিন্তু অধ্যাপকরা এসব মেডিকেলে যেতে আগ্রহী নন। রাজধানীর বাইরে তাদের কোনোভাবেই পাঠানো যাচ্ছে না। তারা শিক্ষকতার চেয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

স্বাস্থ্য প্রশাসনের চিকিৎসকরা বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে দক্ষ হলেও নিয়মিত পরিচালক না থাকায় অধ্যাপকরাই তাদের পদে দায়িত্ব পাচ্ছেন। আবার শিক্ষকরা প্রশাসনিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে না পারায় প্রকল্পের অনেক কাজে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নমূলক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে চিকিৎসকদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে দীর্ঘ দিনের অসন্তোষ।

স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) পরীক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাডারে উন্নীতরা মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাদের পদায়ন করা হয়। দুই বছর পর তারা উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির সুযোগ পান। এরপরই মূলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের পৃথককরণ শুরু হয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুটি স্তরে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রশাসনে বিভক্ত হন চিকিৎসকরা।

আবার স্বাস্থ্য শিক্ষার দুটি শাখা ক্লিনিক্যাল ও নন-ক্লিনিক্যাল। নন-ক্লিনিক্যাল চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য শিক্ষার মৌলিক বিষয় অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, এপিডেমিওলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিনসহ বিভিন্ন কোর্সে উচ্চতর ডিগ্রির পড়াশোনা করেন। ডিগ্রি শেষে তারা শুধু মেডিকেল শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হবেন। শিক্ষকতার বাইরে তাদের রোগী দেখা বা প্র্যাকটিস করার সুযোগ নেই। কোনো কোনো সময় তারা সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে যোগদান করতে পারেন।

অন্যদিকে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে উচ্চশিক্ষার কোর্স মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি অ্যান্ড অবস, পেডিয়াট্রিকস, কার্ডিওলজি, অফথালমোলজি, অর্থোপেডিকস, নিউরোলজি, নিউরোসার্জারি, কার্ডিয়াক সার্জারিসহ বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রিপ্রাপ্তরা চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ক্লিনিক্যাল ও নন-ক্লিনিক্যালথ এই দুই শাখার চিকিৎসকদের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে পদায়ন করা হয়।

আবার ক্লিনিক্যাল ডিগ্রিধারী কেউ কেউ সদর হাসপাতালগুলোতে কনসালট্যান্ট পদে পদায়ন পান। মেডিকেল কলেজে পদায়নকৃত চিকিৎসার পাশাপাশি এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন। কনসালট্যান্টরা রোগীর সেবার পাশাপাশি বিভিন্ন প্যারামেডিকস কোর্সে ক্লাস নেবেন।

মেডিকেল কলেজে পদায়নকৃতরা সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। কনসালট্যান্ট হিসেবে পদায়নকৃতরা মাত্র একধাপ পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র কনসালট্যান্ট হন। এই পদটি সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার। সিনিয়র কনসালট্যান্টরা চাকরি জীবনের শেষ দিকে গিয়ে কখনো কখনো বড়জোর চলতি দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক হন।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, করোনা মহামারী মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ পরিকল্পনা সাজালেও বাংলাদেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা করতে গিয়ে ‘বিজ্ঞানকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছেন’।

এ দেশের বিজ্ঞানীরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন, সেগুলো পাশ কাটিয়ে তাদের (প্রশাসন ক্যাডার) নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। আমলারা ব্রিটিশ আমলের শাসনব্যবস্থা অনুযায়ী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থেকে এসব করা হচ্ছে। কোভিড মহামারীর সময় আরেকটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সৎ ও মেধাবীদের প্রয়োজন। যারা অনিয়ম ও দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পেতে কাজ করবেন। পাশাপাশি যারা স্বাস্থ্য বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাদের স্বাস্থ্য প্রশাসনে নিয়োগ দিতে হবে।

কারণ হাসপাতালগুলোতে কোথায় কী প্রয়োজন, কোনটি অগ্রাধিকার দিয়ে কিনতে হবে তা একজন মাঠপর্যায়ের লোক বুঝতে পারবেন। কিন্তু যারা স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করেননি তাদেরকে স্বাস্থ্য প্রশাসনে বসানো হলে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম হওয়ার সম্ভবনা বেশি।

ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস (এফডিএসআর)-এর উপদেষ্টা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে দুর্নীতিবাজদের সাজা দেওয়া দরকার। স্বাস্থ্যের একজন গাড়িচালক ১০০ কোটি টাকার মালিক। তাহলে সচিব-উপসচিবসহ অন্যরা কী পরিমাণ টাকা আয় করেন, চিন্তা করা যায়!

বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরীর বলেন, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সে সময় তাদের কথা শোনা হয়নি। চিকিৎসকদের উদ্বেগ প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন প্রত্যেকটা জায়গায় দখলদার ও খবরদারি করতে চায়।

তিনি বলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যবস্থাপনা দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর স্বাস্থ্য খাত চলতে পারে না। সরকারকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও প্রশাসনকে পৃথক করে কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন করতে হবে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিব) সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ আজিজ বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের পদ ১১৩টি। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে ৬১০ জনকে। তাদের পদায়নের জন্যই বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তাছাড়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন বিভাগে অ্যাডমিনের (প্রশাসন) লোকজন ঢোকানো হচ্ছে। নার্সিং, পরিবার পরিকল্পনায় তাদের লোকজন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা আমাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেবেন, তা না করে খবরদারি করছেন।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি বলেন, মন্ত্রণালয়ে যারা স্বাস্থ্য প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেন তারা সঠিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বোঝেন না।

এর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব, উপ-সচিব চিকিৎসকদের করা, যা বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে। উপজেলা থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যে চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য প্রশাসনে থাকবেন, তাদের স্বাস্থ্য প্রশাসন পরিচালনায় প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করার পরামর্শ দেন তিনি।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, চিকৎসক-প্রশাসনের এ ধরনের অসন্তোষ নতুন কিছু নয়। মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘদিনের সিস্টেমেই এটি চলে আসছে। দেশে ২৯টি ক্যাডার সার্ভিস আছে। স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার করতে চাইলে অন্য খাতেও করতে হবে।

এসবের বাইরে আমাদের কাছে বড় বিষয়, মানুষের স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া। সব দাবি পূরণ করতে গেলে সেটাও সমস্যা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!