ঢাকা : বিশ্বে সবচেয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজধানী ঢাকা। এ শহরে ধনীদের জীবন বেশ সুখের হলেও অধিকাংশের দিন কাটে চরম কষ্টে।
অর্থবিত্তশালীরা বিনোদন আর আনন্দে সময় কাটালেও মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত সবাইকে প্রতিনিয়ত করতে হচ্ছে জীবনযুদ্ধ। কারণ ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যে-কোনো শহরের চেয়ে অনেক বেশি।
প্রায় দুই কোটি মানুষের উচ্চ ব্যয়ের এই শহরে সীমিত আয়ের মানুষ জীবন ধারণ করেন কোনোমতে। তবুও দিনদিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ে না বছরের পর বছর ধরে। ব্যয়ের সাথে আয়ের ভারসাম্য নেই।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবনযাত্রার এই চাপ হতাশার সৃষ্টি করে। আর এই হতাশার কারণে অনেক নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
বর্তমানে করোনা মহামারীতে জীবন এবং জীবিকার সমন্বয় মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্তের সামনে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিকার সন্ধানে থাকা মানুষগুলো এখন কঠিন সত্যের মুখোমুখি। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবিকা রক্ষায়ই এখন বড় ব্রত।
ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঢু দিলেই দেখা যাবে পরিপাটি বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট লেখা সাইনবোর্ড। পাড়ার মোড়ের দেয়ালগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ছেয়ে থাকে। অথচ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে টু-লেট, সাবলেট অগণিত বিজ্ঞাপন।
সাবলেট অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখানে কোনো ছোট পরিবারের এক রুমের বাসা ছিল। কিন্তু করোনার থাবা তাদের সেই আশ্রয়ও কেড়ে নিয়েছে। নিদারুণ কষ্টের এসব কথা অন্যকে বলা যায় না।
কর্মহীনতার কষ্ট, না খেয়ে দিনযাপন এগুলো হয়তো বড়রা করল। কিন্তু বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েগুলো? তাদের খিদের কষ্ট, স্কুলে না যাওয়ার কষ্ট কিংবা তাদের ছোট ছোট আবদার পুরোন করতে না পারার কষ্ট মধ্যবিত্ত সমাজের জানানোর জায়গা নেই।
এদিকে রাজধানীতে বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। নেই কোনো নীতিমালাও। যখন ইচ্ছে তখনই বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করে বাড়ির মালিকরা। সিন্ডিকেট করে খাদ্যদ্রব্য কিংবা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বাড়ে যখন-তখন। আবার গণপরিবহনেও ভাড়া নিয়ে চলে নৈরাজ্য। বাসে উঠলেই সর্বনিম্ন ভাড়া গুনতে হয় ১৫ টাকা।
সব মিলিয়ে রাজধানীতে বাড়তি ব্যয়ের চাপে ত্রাহি দশা সীমিত আয়ের লাখ লাখ মানুষের। চাকরি কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা হারিয়ে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত সকলেই আজ অথৈ সমুদ্রে। সেই সমুদ্রের ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য পরিবারগুলোও।
এলাকা থেকে একজন ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ার অর্থ, সে মানুষটি যে মুদি দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করত বিপদটা দোকানদারের ঘাড়েও এসে পড়ল। ইদানীং শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী।
এই যেমন বাচ্চাদের খেলনাওয়ালা, ডাবওয়ালা, সবজিওয়ালা ইত্যাদি। এরা অনেকেই এ পেশায় নতুন, পুরোনো কাজ হারিয়ে নতুন পেশা বেছে নেওয়া অর্থাৎ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নিম্নমধ্যবিত্ত তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, গত বছর শ্রমিকের বেতন বাড়েনি। কিন্তু সকল সূচকেই বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। আর দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রা ব্যয়ের প্রভাব পড়েছে ১৬ কোটির অধিক মানুষের ওপর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। আয় বৈষম্য দূর করাও জরুরি বলে মত তাদের।
এদিকে গতকাল বুধবার ক্যাব-এর প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন বছরের মধ্যে ২০২০ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ সময়ে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের আয় রোজগার ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। এতে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভোক্তাদের জীবনমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ও পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। পূর্ববর্তী ২০১৯ সালে এ বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।
২০২০ সালে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বছরের শেষে আমন ধানের ভরা মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি থেমে থাকেনি।
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
এর মধ্যে মোটা চালের দাম বেড়েছে (পারিজা ও স্বর্ণা) ২৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ, পাইজাম চালে ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, বিআর৮ ও বিআর১১ চালে ২০ দশমিক ৬৮ শতাংশ, মিনিকেট চালে ১৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ, নাজিরশাইল চালে ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং সুগন্ধি চালের গড় দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
আটার মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে কেজি প্রতি ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। দেশি ও আমদানি করা ডালের দাম গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। দেশি মসুর ডালে ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, আমদানি করা মসুর ডালে ৪৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং খেসারির ডালে দাম বেড়েছে ২৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
ভোজ্যতেলের দাম গড়ে বেড়েছে ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে খোলা পাম অয়েলে ১৭ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। চিনি ও গুড়ের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
মসলার দাম গড়ে বেড়েছে ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে এলাচে বেড়েছে ১০৪ দশমিক ১৮ শতাংশ, দেশি শুকনা মরিচে ৪০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, কাঁচামরিচে ৩১ দশমিক ৯৬ শতাংশ, আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ৩১ দশমিক ০৪ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজে ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ, আমদানি করা পেঁয়াজে ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং আমদানি করা শুকনামরিচে দাম বেড়েছে ৩০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে করলার ৩৪ দশমিক ৩০ শতাংশ, কাঁচা পেঁপে ৩১ দশমিক ১৬ শতাংশ, দেশি আলুতে ২৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং আলুতে (হল্যান্ড) বেড়েছে ২৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
২০২০ সালে ২০১৯-এর তুলনায় গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়েছে গড়ে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, মুরগির দাম ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর ডিমের দাম গড়ে বেড়েছে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। মাছের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। গড়ে গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের গড় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ, এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফ্ল্যাট বাসায় ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, বস্তিতে ঘর ভাড়া বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং মেসের ৮ সিট বিশিষ্ট রুমের ভাড়া বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে সাধারণ শাড়ি-কাপড়ের দাম বেড়েছে গড়ে ৯ শতাংশেরও বেশি।
ওয়াসার পানি প্রতি হাজার লিটারে দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আবাসিকে বিদ্যুতের গড়মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক বিদ্যুতে মূল্য বেড়েছে গড়ে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
যেসব পণ্যের মূল্য কমেছে : সরিষার তেলের দাম প্রতি কেজিতে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ, ডালডাতে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং খোলা আটার দাম কমেছে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ। আমদানি করা মটরডালের মূল্য কমেছে কেজি প্রতি ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ আর দেশি মটরডালে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
শাকসবজির মধ্যে পটোলের দাম প্রতি কেজিতে ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, শসা বা খিরার মূল্য কমেছে ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ, বেগুনে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, মুখিকচুতে ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। মসলার মধ্যে গোলমরিচের দাম কমেছে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
গরুর তরল দুধের দাম কমেছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ছোট ইলিশ মাছের মূল্য কমেছে গড়ে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ, ছোট চিংড়ির দাম ১ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং পাঙাশ মাছের দাম ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে।
যেসব পণ্য ও সেবার মূল্য স্থিতিশীল : সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালে লবণ, চা-পাতা, দেশি-বিদেশি কাপড় স্থিতিশীল ছিল।
অন্যদিকে সব ধরনের জ্বালানি তেল এবং চুলার গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত ছিল। সড়ক, নৌপথ ও রেলের নির্ধারিত ভাড়ারও পরিবর্তন করা হয়নি।
তবে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাস মালিকদের চাপে অর্থেক আসন খালি রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহনের শর্তে ৬০ শতাংশ অধিক হারে ভাড়া আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়।
অভিযোগ ছিল, যাত্রীদের নিকট থেকে আরো অধিক হারে ভাড়া আদায় করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থবিধি মানা হয়নি।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, মানুষের আয় যদি জীবনযাত্রার ব্যয়ের চেয়ে বাড়ে, তাহলে সমস্যা নাই। যদি জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে আয় না বাড়ে, মানুষের কষ্ট হয়। তখন জীবনযাত্রার মানও কমে যায়। যাদের আয় বাড়ছে না, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কখনোই কাম্য নয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম মনে করেন, ঢাকা শহর নানা দিক দিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এর মধ্যে প্রতিদিনই বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এটা বড় ধরনের মানসিক চাপে রাখছে ঢাকার অধিবাসীদের। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। তাই নগরজীবনের ওপরে এ বাড়তি চাপ কমাতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :