ভূরাজনীতির ফাঁদে টিকার ভাগ্য

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২১, ০৪:০২ পিএম
ভূরাজনীতির ফাঁদে টিকার ভাগ্য

ঢাকা : করোনা ভ্যাকসিন সংকটে আটকে আছে দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষাসহ সামগ্রিক জীবনযাত্রা। দ্রুত ভ্যাকসিন পেতে বিভিন্ন দেশের সাথে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। অনেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও দিচ্ছে না ভ্যাকসিন। তাই মাত্র কদিন আগেও হতাশার সুর ঝরে পড়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কণ্ঠে।

সম্প্রতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় সেই হতাশা কেটে নতুন আশা জাগাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি ভ্যাকসিনকে ভূরাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে শক্তিশালী দেশগুলো। এমনকি তারা সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের শর্তে অনেক দেশকে ভ্যাকসিন দিচ্ছে। বাংলাদেশও ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে ভূরাজনীতির ফাঁদে পড়েছে। তাই চীনের সাথে টিকা নিয়ে চুক্তির কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চীনবিরোধী একটি জোট ‘কোয়াড’ সক্রিয় রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে এই জোটের সমর্থক হিসেবে বাংলাদেশকে পেতে চায়।

একারণে, যুক্তরাষ্ট্র যখন দেখলো ভারতের কাছ থেকে ভ্যাকসিন না পেয়ে বাংলাদেশ আশাহত; অন্যদিকে, চীনের সাথেও ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তি করে ফেলেছে এবং চুক্তির আগে তারা উপহার হিসেবেও কিছু দিয়েছে, তখন বাংলাদেশ যাতে শুধুমাত্র চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ২৫ লাখ ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণাটি দিয়েছে। এই প্রতিযোগিতাই হচ্ছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।’

অন্যদিকে, চীনবিরোধী জোট কোয়াডের বাইরের দেশগুলোকে ভ্যাকসিন সহায়তার মাধ্যমে

জোটকে ভেঙে দিতে চাইছে। মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘এই প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই চীন আমাদের ভ্যাকসিন দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যাতে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক উন্নত হয় এবং চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ অবস্থান না নেয়। এখানে বাংলাদেশও কূটনৈতিক সফলতা-ব্যর্থতারও মাঝে ভারসাম্য করার চেষ্টা করেছে।’

সম্প্রতি কোয়াডে বাংলাদেশকে যুক্ত করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন তৎপর, তখন এনিয়ে বাংলাদেশকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিল চীন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আর একারণেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাগে আনতে না পারলেও বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে না পড়ে সেজন্য ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র টিকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।

অন্যদিকে, ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে শুরুর দিকে বাংলাদেশের কেবল ভারতের প্রতি নির্ভরশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বলে মনে করেন মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘বুঝেই হোক, না বুঝেই হোক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি মাত্র সোর্স থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ নিজেদের ভ্যাকসিন উৎপাদনের আগে যখন যেখান থেকেই পেরেছে ভ্যাকসিন কিনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বায়োএনটেক, ফাইজার এমনকি অ্যাস্ট্রাজেনেকা অক্সফোর্ড টিকা কিনেছিল।

এরপর যখন তাদের নিজেদের ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেছে তখন তারা ক্রয়কৃত ভ্যাকসিনগুলো ব্যবহার করছে না বা করবে না। সেই টিকাগুলোই মূলত তারা এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে উপহার হিসেবে প্রদান করছে।’

প্রসঙ্গত, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তিন কোটি ডোজের চুক্তি করলেও এর মধ্যে মাত্র ৭০ লাখ পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি ৩২ লাখ ডোজ ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দেওয়া।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘ভারত থেকে এই টিকা যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল তার সমাধান এখনো হয়নি। একইসঙ্গে অন্যান্য স্থান থেকেও এই টিকা পাওয়া সম্ভব না।’

কোভিশিল্ডের সংকট দেখা দেওয়ায় ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ দেওয়া এবং ২ মের পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় টিকার জন্য নিবন্ধনও। গত ১৯ জুন থেকে চীন সরকারের উপহার সিনোফার্মের টিকা দিয়ে দেশে আবারো শুরু হয় টিকাদান কার্যক্রম।

প্রাথমিকভাবে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত এই টিকা দেওয়া হয়েছে ৪৫৭ জনকে। চীন এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে মোট ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা উপহার দিয়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজার ডোজ এ দেশে কর্মরত নিজেদের কর্মীদের জন্য নেয় চীন। উপহার ছাড়াও চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে দেড় কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এছাড়া, গত ২৫ জুন কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

তিনি বলেন, ‘টিকা পেতে গত জুনে কোভ্যাক্সকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। সেই হিসাবে পর্যায়ক্রমে প্রায় সাত কোটি টিকা দেওয়ার কথা আমাদের।’

অন্যদিকে, গত ৩১ মে কোভ্যাক্সের আওতায় ফাইজার-বায়োএনটেকের এক লাখ ৬০২ ডোজ টিকা দেশে পৌঁছানোর পর গত ২১ জুন এ টিকা দেওয়া শুরু হয়। তবে তাদের সাত দিনের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

সোনালীনউজ/এমটিআই

Link copied!