কঠিন সমীকরণে কঠোর লকডাউন

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২১, ০৯:২৫ পিএম
কঠিন সমীকরণে কঠোর লকডাউন

ঢাকা : একদিকে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল, অন্যদিকে জীবন-জীবিকা। সেইসাথে ধর্মীয় আবেগ আর অনুভূতি। ত্রিমুখী এই সমীকরণের সমাধানে হিমশিম সরকার। 

এমনই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) থেকে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে। তবে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর চলমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ শিথিলে পরিস্থিতি কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটা নিয়েও আছে যথেষ্ট উদ্বেগ ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার উচ্চ সংক্রমণরোধে প্রয়োজন ন্যূনতম তিন সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধ। কিন্তু আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। 

এরইমধ্যে ঈদকে ঘিরে নাঁড়ির টানে গ্রামে ছোটা শুরু করেছেন লাখো মানুষ। আবার কোরবানির পশু কেনাবেচায় জড়িত হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। এই সব কিছু সমন্বয় করে কীভাবে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এই জটিল সমীকরণ ভাবিয়ে তুলছে সরকার সংশ্লিষ্টদের।

গতমাসে দেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর দ্রুত অবনতি হতে থাকে করোনা পরিস্থিতির। সংক্রমণ রোধে সারা দেশে গত ১ জুলাই থেকে চলছে লকডাউনের আদলে কঠোর বিধিনিষেধ। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, গত দুই সপ্তাহের লকডাউনের অর্জন নির্ভর করছে তৃতীয় সপ্তাহের কার্যক্রমের ওপর। সব দিক দিয়েই ১৪ তারিখের পর থেকে পরবর্তী সাত দিন অর্থাৎ কোরবানির দিন ২১ জুলাই পর্যন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বলেন, ‘যে কোনো দেশে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে সর্বনিম্ন তিন সপ্তাহের লকডাউন দরকার। যত দীর্ঘ সময় লকডাউন হবে, তত বেশি সেটা কার্যকর হবে।’

কিন্তু সামনে কোরবানির ঈদ, বসবে পশুর হাট। মানুষ কোরবানির পশু কিনতে যাবে বাজারে। আবার যত বিধিনিষেধই থাকুক না কেন ঈদ উপলক্ষে সাধারণ মানুষের গ্রামের বাড়ি যাওয়া আটকানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই সব কিছু ঠিক রেখে যতটা কম ঝুঁকি নিয়ে কোন কৌশলে এই সব কিছুই বজায় রাখা যায় সেই কৌশল নির্ধারণে গলদঘর্ম নীতিনির্ধারকরা। 

এবিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, এ সময়ে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নিয়মেই এটি বড় ধরনের চাপ। তাই কোনো কৌশলে সব মানুষকে লকডাউনের মধ্যে ঈদুল আজহা উদযাপন করানো যায়,পশুর হাটে যাতে কম ক্রেতা আসেন এবং তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মানেন-এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে কৌশল খোঁজা হচ্ছে। এরকম জটিল পরিস্থিতিতে করোনার উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও কোরবানি ঈদ ও পশুর হাট বিবেচনায় নিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে ৮ দিনের জন্য শাটডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া চলমান কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 

কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ সময় শর্তসাপেক্ষে চলবে গণপরিহন। দোকানপাটসহ প্রায় সবকিছুই চালুর অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে কোরবানির হাটও চলবে। এসব বিষয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুয়ায়ী কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত  হয়নি। তবে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে সরকার। 

সূত্র জানায়, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে সাধারণ মানুষের আর্থিক দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার চলমান লকডাউন মেয়াদ ২৩ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়িয়ে বিধিনিষেধ শিথিল করার কথা ভাবছে। তবে ঈদের পর ফের ১৪ দিনের জন্য শাটডাউন দেওয়া হবে।

সূত্রটি জানায়, ঈদ উপলক্ষে শিথিল শাটডাউনের আট দিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে এক আসন ফাঁকা রেখে চলবে সব গণপরিবহন। এ সময়ে সরকারি অফিস ভার্চুয়ালি খোলা থাকলেও বন্ধ থাকবে বেসরকারি অফিস। ১৫ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ২৩ জুলাই ভোর ৬টা পর্যন্ত শাটডাউন শিথিলের আদেশ কার্যকর থাকবে। ঈদের পর আবারো দুই সপ্তাহের শাটডাউনে যাবে দেশ। 

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ সামাল দিয়ে যাত্রা নির্বিঘ্ন করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গত এক বছরে করোনাকালীন সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

গত রোজার ঈদে বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রেখেছিল সরকার। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে ঈদের আগে ঘরমুখী হয় মানুষ। ফেরিঘাটে ঘরমুখী মানুষের ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছিল সরকার। কর্তৃপক্ষের অনুরোধ তোয়াক্কা না করে বাড়িমুখী হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। 

গত ১২ মে মাদারীপুরের বাংলাবাজারে দুটি ফেরি থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে ভিড়ের চাপে পাঁচজনের মৃত্যুও হয়। ওই ঘটনায় পদদলিত হয়ে হতাহত হয় অর্ধশতাধিক। এসব ঘটনা এড়াতেই এবারের ঈদে গণপরিবহন চালু রাখতে চাচ্ছে সরকার।

চলতি মাসের শুরু থেকে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পর থেকেই আসন্ন ঈদকে ঘিরে কী ধরনের সিদ্ধান্ত হতে পারে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিল সরকার সংশ্লিষ্টরা। 

এবিষয়ে সম্প্রতি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলন, সরকার এবার আরো কঠিন বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ভেবেচিন্তে পরবর্তী সিদ্ধান্ত দিতে চায়। 

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কিছুই বলা ঠিক হবে না। ১৪ জুলাইয়ের পরও সরকারি বিধিনিষেধ (লকডাউন) থাকছে কিনা সেটি বিদ্যমান পরিস্থিতি কঠিনভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

তবে যাই হোক, এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা জারি করা হবে ১৩ জুলাই, মঙ্গলবার। 

ফরহাদ হোসেন বলেন, যেহেতু সামনে কোরবানির ঈদ এবং হাট আছে, এ দুটিকে একত্রিত করে সংক্রমণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটিই এখন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেটিই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। সরকারের পক্ষ থেকে পশুর হাটগুলোকে কতটা সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে শলাপরামর্শ করা হচ্ছে।

এদিকে রাজধানীতে পশুর হাটের বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

সোমবার (১২ জুলাই) দুপুরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার সারা দেশে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ে অনলাইন প্ল্যাটফরম চালু করেছে। খামারি ও ক্রেতাসাধারণকে কোরবানির পশু অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের অনুরোধ করা হচ্ছে।

অন্যদিকে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, আগামী ১৭ জুলাই রাজধানীতে হাটে পশু কেনাবেচা শুরু হবে। রাজধানী ঢাকায় ১৮টি অস্থায়ী পশুর হাট বসবে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮টি হাট বসবে।

তবে ঢাকার বাইরে অনেক স্থানে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই বেশ আগে থেকেই বসে গেছে পশুর হাট। জামালপুর পৌর শহরের ধর্মকুড়া বাজার ও উপজেলার নাপিতেরচর গাইবান্ধা গরুর হাট বসে গত ৪ জুলাই থেকে।

দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধের পরও পঞ্চগড়ের বিভিন্নস্থানে বসছে পশুর হাট। জেলার বোদা উপজেলার নগরকুমারীতে পশুর হাট বসেছে। হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি ক্রেতা-বিক্রেতাদের। 

জানা যায়, সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও বুধবার ঐতিহ্যবাহী হাটটি বসে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জেও বসেছে জনতার বাজার পশুহাট। তবে নির্ধারিত সময়ের পর বাজার বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। পটুয়াখালী গলাচিপা উপজেলার গোলখালী ইউনিয়নের নলুয়াবাগী এলাকায়ও বসে পশুর হাট। যদিও পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে হাটটি বন্ধ হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!