ঢাকা : করোনাকালে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুজ্বর। দেশে করোনা রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৬৪৫ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ২৭৩ জন আক্রান্ত হয়েছে জুলাই ও আগস্ট মাসে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে, তা হালনাগাদ পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিষয়টি খুবই চিন্তার। ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে হলে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোও খুব জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চলতি মাসের ১৩ দিনেই (১ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৯৮৭ ডেঙ্গু রোগী। এরমধ্যে গত একদিনে আক্রান্ত হয়েছেন ২১১ জন। ডেঙ্গু সন্দেহে এখন পর্যন্ত এ বছর মৃত্যু হয়েছে ২৪ জন। এর মধ্যে ঢাকাতেই আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২১১ জন এবং ঢাকার বাইরে ১৭৬ জন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু সন্দেহে ২৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। তবে আইইডিসিআর এখনো কোনো মৃত্যুর পর্যালোচনা সমাপ্ত করেনি এবং কোনো মৃত্যু ডেঙ্গু বলেও নিশ্চিত করেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুসারে, গত ০১ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৩৭ জন, ০২ আগস্ট ২৮৭ জন, ০৩ আগস্ট ২৬৪ জন, ০৪ আগস্ট ২৩৭ জন, ০৫ আগস্ট ২১৮ জন, ০৬ আগস্ট ২১৪ জন, ০৭ আগস্ট ২০৪ জন, ০৮ আগস্ট ২২৪ জন, ০৯ আগস্ট ২১০ জন, ১০ আগস্ট ২২৬ জন, ১১ আগস্ট ২১৩ জন এবং ১২ আগস্ট ২৪২ জন। ১৩ আগস্ট ২১১ জন।
এদিকে ডেঙ্গুতে তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। ঢাকা শিশু হাসপাতালে ঠাঁই নেই। এখানে ডেঙ্গু বেডের চেয়ে রোগী অনেক বেশি। পুরো হাসপাতালই এখন বলতে গেলে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় নিয়োজিত।
তবে শিশু হাসপাতালের চিকিৎকরা বলছেন, তাদের প্রস্তুতির ঘাটতি নেই, কোনো শিশু রোগীকেই তারা ফিরিয়ে দিচ্ছেন না।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কিংকর ঘোষ বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকই শিশু। হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য মোট ১৫টি বেড নির্ধারণ করা আছে। সেখানে আমরা শুধু ডেঙ্গুর জটিল রোগীদেরই রাখছি। যাদের আইসিইউ প্রয়োজন হয়, তাদের আইসিইউতে পাঠাচ্ছি। বাকিদের আমরা অন্য বেডে ভর্তি নিচ্ছি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো শিশুকেই আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি না। এজন্য আমরা একটি র্যাপিড রেসপন্স টিম করেছি।
তিনি জানান, এবার ডেঙ্গু ২০১৯ সালের টাইপ-থ্রি ধরনের। ওই সময়ে ঢাকার প্রাপ্তবয়স্করা এই ডেঙ্গুতে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হন। তবে একই টাইপে একজন দুইবার আক্রান্ত হবেন না। তাই শিশুরা এখন আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফি আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জন্য আইসিইউ নিয়ে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
আমার ১৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১০টিতে এখন ডেঙ্গু রোগী। তাহলে বাকি যাদের আইসিইউ প্রয়োজন তাদের নিয়ে কী করব। খুবই খারাপ অবস্থা। আর ডেঙ্গু রোগীর ম্যানেজমেন্টও কঠিন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তরল খাবার দিতে হয়। তারপরও কাউকে আমরা ফেরাচ্ছি না।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর এবারের টাইপটি শিশুদের আক্রান্ত করে বেশি। শিশুরা এখন করোনার কারণে বাসায়। গরমের কারণে তাদের খালি গায়ে রাখা হয় বা হাফ শার্ট, হাফ প্যান্ট পরানো হচ্ছে। ফলে তাদের এডিস মশা কামড়াচ্ছে বেশি। এই মশা ডাইনিং টেবিল ও পড়ার টেবিলের নিচে বেশি থাকে। আর বাচ্চারা অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে টেবিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে এডিস মশার কামড় খাচ্ছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ডা. শফি আহমেদ জানান, জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে। শুরুতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর বয়সি শিশু রোগী বেশি পাওয়া গেছে। এখন যারা আসছে, তাদের বয়স পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে বলে জানান চিকিৎসকরা।
তবে শুধু শিশু হাসপাতালই নয়, ঢাকার অন্য হাসপাতালেও শিশু রোগী বেশি বলে জানা গেছে। শিশু হাসপাতালে শুধু শিশুদেরই ভর্তি করা হয়।
অন্যদিকে রাজধানীর জালাধারগুলো যেন মশার অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। এই মশাগুলোই সন্ধ্যার পর আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা নিধন খাতে বরাদ্দ বাড়ে, সাথে সাথে বাড়ে মশাও।
২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশা নিধনে ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। অথচ দিনদিন মশা বাড়ছে, বৈ কমছে না।
বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, এই টাকা কি মশাদের পেটে যাচ্ছে, নাকি সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের পকেটে যাচ্ছে। অবশ্য সিটি করপোরেশন থেকে বলা হচ্ছে, বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে মশা বৃদ্ধি বা কমার কোনো সম্পর্ক নেই। মশা নিধনে তারা ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখেন।
তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ রয়েছে, সিটি করপোরেশনের মশা নিধনের ওষধু কাজ করে না।
ঢাকার গুদারাঘাটে গুলশান (হাতিরঝিল) লেকপাড় এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ‘আমরা যখন ছোট আছিলাম তহন দেখেছি একবার ওষুধ ছিটালে সাতদিন কোনো মশা আছিল না। আর এখন কী ওষুধ ছিটায়, মশা তো কমেই না, উলটা বাড়ে।’
এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নতা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, এডিসবাহিত ডেঙ্গু এ বছর আবার অত্যন্ত আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুর মহামারি ঘটেছিল। তাই এবার সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) বর্তমানে ৮৯৬ রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছে ৮২৪ আর বাকি ৭২ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে। তাছাড়া, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৩৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬২ জন আক্রান্ত হয়েছে জুলাই ও আগস্ট মাসে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৪ হাজার ৫১৬ জন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু সন্দেহে ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি এখনো মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা শেষ করেনি এবং একটি মৃত্যুও ডেঙ্গু বলে নিশ্চিত করেনি।
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেছেন, ডেঙ্গুতে জ্বর-ব্যথা যে কোনো সমস্যায় প্যারাসিটামলের বাইরে অন্য কোনো ওষুধ খাবেন না। পাশাপাশি পানি-শরবত এগুলো খেতে হবে। অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। তাতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। জ্বর-সর্দিকাশি-গলাব্যথা হলে ডেঙ্গু-করোনা দুটিরই পরীক্ষা করাতে হবে। ওষুধ-পরীক্ষা সব কিছুই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে। অবহেলা করা যাবে না। শুরুতেই সতর্ক হতে হবে।
তিনি বলেছেন, ঘরবাড়ির আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোথাও যেন তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি জমা পানি না থাকে। ঘরের আনাচকানাচ পরিষ্কার রাখতে হবে। ফ্রিজের নিচে-টবে পানি যেন না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে ছাদবাগান করে, সেখানে পানি জমার সম্ভাবনা থাকে। সেখানে সতর্কতার সঙ্গে পানি পরিষ্কার করতে হবে। আর নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা মশা নিধনে কাজ করছে। যে কাউন্সিলরের ওয়ার্ডে সবচেয়ে কম ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
তিনি জানান, জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২৭ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চিরুনি অভিযান চালয়। অভিযানের অংশ হিসেবে জনগণকে সচেতন করা হয়। সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা বাড়ি মালিককে জরিমানা করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন-করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা, আরেকদিকে ননকোভিড রোগীদের চিকিৎসা, নমুনা পরীক্ষা, টিকাদানের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এ অবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় আলাদা হাসপাতাল নির্ধারণ করা হচ্ছে।
এগুলো ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই বিষয়ে দ্রুত জানিয়ে দেওয়া হবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :