ঢাকা : আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলে দক্ষিণ এশিয়া এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ নিয়ে হিসাব কষছে বিভিন্ন দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়েও চলছে বিচার-বিশ্লেষণ।
কেউ বলছেন, তালেবানের ক্ষমতা দখলের ফলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তালেবানের রাতারাতি ক্ষমতা দখলের কৃতিত্বে অনুপ্রাণিত হতে ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
তারা আগের মতোই আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের তালিম নিয়ে বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের অপচেষ্টা চালাতে পারে।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জঙ্গিবাদের চেয়েও তালেবানকে পুঁজি করে এই অঞ্চলে শক্তিশালী দেশগুলোর ভিন্ন রাজনৈতিক খেলায় মেতে ওঠার বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বলে মনে করছেন।
কারণ মার্কিন সরকার দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অবস্থান করেও আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেনি।
অন্যদিকে, তালেবানের অগ্রযাত্রার মাঝেই আফগান সরকারকে বিপদের মুখে ফেলে মার্কিন বাহিনী শুধু তার নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত দেশত্যাগ করেছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে নতুন করে ভূরাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার পায়তারা চলছে কি না, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমত আফগানিস্তান যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, সেহেতু দেশটিতে যদি কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয় তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়বে। দ্বিতীয়ত দেশটিতে মানবিক সংকট, যা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে রিফিউজি সংকটের প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে। তৃতীয়ত এখানে ক্ষমতার নতুন বলয় সৃষ্টি হচ্ছে। এতে আঞ্চলিক রাজনীতিতে মেরুকরণ হবে। এর প্রভাব এই অঞ্চলের বাইরেও বৃহৎ পরিসরে পড়বে।’
এদিকে অতীতের তালেবান এবং বর্তমানের তালেবানের চরিত্রের সাথে বেশ ফারাক রয়েছে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সশস্ত্র গ্রুপটি ক্ষমতা দখলের পরপরই দেশটিতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পাশাপাশি নারীশিক্ষার অধিকার দেওয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নিজেদের দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না বলে জানিয়েছে।
এছাড়া ক্ষমতা দখলের আগে চীনের মতো একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে যেভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছে তা ছিলো অনেকটা নজিরবিহীন।
ফলে অতীতে তালেবান জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা হিসেবে বিশ্বে যেভাবে পরিচিতি পেয়েছিলো, এবার ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সেই অবস্থান থেকে সরে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার তালেবান চাইবে নিজেদের কপাল থেকে জঙ্গি সংগঠনের তকমা মুছে দিতে।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, ‘তালেবানের ক্ষমতা দখল এই অঞ্চলে ভূরাজনীতির একটি নতুন খেলা। আফগানিস্তানে বর্তমানে যে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণে আঞ্চলিক শক্তিগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। সেখান থেকেই সংঘাতের উন্মেষ ঘটতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এর প্রভাবের শঙ্কা রয়েছে। তালেবান অতীতের কট্টরপন্থা থেকে সরে গিয়ে তালেবান বর্তমানে বেশ সমঝোতামূলক অবস্থানে আসতে চাচ্ছে। তারা জঙ্গিরূপ পরিবর্তন করে এটিকে রাজনৈতিক রূপে রূপান্তর করতে চাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গ্রহণযোগ্যতা পেতে চাচ্ছে।
এছাড়া, এর আগে তালেবান পাকিস্তানের একক নিয়ন্ত্রণে ছিলো। কিন্তু এবার তাদের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে একক কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেই। যার ফলে অতীতে যেভাবে তারা কাজ করতো সেটি এবার সম্ভবপর হবে না।’
তবে তালেবানের হাত ধরে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেননি এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক। এ নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ারও কিছু নেই বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, তালেবানের কথায় আস্থা না রেখে সরকারকে জঙ্গিবাদের বিস্তাররোধে একটি নিরাপত্তা কৌশল তৈরির পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য সুবিধাজনক হলো আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব। মাঝখানে ভারত আমাদের জন্য একটি দেয়াল হিসেবে কাজ করবে।
জঙ্গিবাদের বিস্তাররোধে জনগণের সম্পৃক্ততা, বৈদেশিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি নিরাপত্তা কৌশল তৈরির করতে পারলে জঙ্গিদের নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই।’
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল কায়দার টুইন টাওয়ারে হামলার অভিযোগে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরই অংশ হিসেবে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে আল কায়দার অবস্থানে ব্যাপক হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। আর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন বাহিনী।
এরপর মার্কিন মদতপুষ্ট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন এবং আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তিশালী করার কথা বলে গত ২০ বছর ধরে অবস্থান করে আসছিলো যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা।
কিন্তু ৩ লাখ আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ হাজার তালেবান যোদ্ধার কাছে পরাজয়ই বলে দিচ্ছে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা দুর্বল অবস্থায় রেখে গেছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :