ঢাকা : প্রায় দেড় বছর ধরে চলা করোনা মহামারির কারণে যাত্রী পরিবহনে রেলের আয় অর্ধেক কমে গেলেও পণ্য পরিবহন ও স্টেট বা সম্পত্তি ভাড়া খাতে আয়ে বেড়েছে বেশ কয়েকগুণ। ফলে করোনাকালে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি রেলের সার্বিক আয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু যাত্রী পরিবহন থেকে বিশ্বের কোনো দেশের রেলওয়ে লাভজনক হতে পারে না। এজন্য অন্য খাতেও নজর দিতে হয়। গত বছর বাংলাদেশ রেলওয়ে সেই ধারাতেই চলছে। আর এই ধারা অব্যাহত রাখা উচিত। করোনার কারণে দুটি অর্থবছর কখনো একেবারেই বন্ধ, কখনো অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলতে হয়েছিল রেলকে।
এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছর প্রায় তিন মাস ট্রেন চলাচলই বন্ধ ছিল। বছরের বাকি সময়ের বেশিরভাগই আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলেছে ট্রেন। এতে রেলের যাত্রী পরিবহনে ধস নামে।
জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন শুরু হয়। প্রথমে ১০ দিন শিথিল থাকলেও পরবর্তী সময়ে বিধিনিষেধ কঠোর করা হয়।
তবে ৫ এপ্রিল থেকেই বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল, যার প্রভাব পড়ে রেলের আয়ে। এছাড়া গত অর্থবছর বেশিরভাগ সময়ই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলেছে ট্রেন। এ কারণে ২০২০-২১ অর্থবছর রেলের যাত্রী পরিবহন খাতে রেলের আয় হয় ৫৩১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছর আয় ছিল ৭৭০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
অর্থাৎ গত অর্থবছর যাত্রী পরিবহন খাতে রেলের আয় কমেছে প্রায় ২৩৯ কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ। এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহনে রেলের আয় হয়েছিল এক হাজার ৩৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
অর্থাৎ করোনার কারণে দুই বছরে যাত্রী পরিবহন খাতে রেলের আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে যায়। তবে বিশাল এই ক্ষতির বেশ খানিকটা রেল পুষিয়ে নিয়েছে পণ্য পরিবহন ও স্টেট খাতে। গত অর্থবছরে করোনার মধ্যেও ট্রেনে পণ্য পরিবহন অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে ভারত থেকে ট্রেনে পরিবহন অনেক বেড়েছে। এর বাইরে সম্পত্তি ভাড়া ও স্ক্র্যাপ বিক্রি থেকেও রেলের আয় বেড়েছে।
গত অর্থবছর পণ্য পরিবহন খাতে (পণ্য, পার্সেল ও ট্রাফিক কমার্শিয়াল) রেলের আয় হয় ৪০৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ আয় ছিল ২৮৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছর পণ্য পরিবহন খাতে রেলের আয় বেড়েছে ৩৯ দশমিক ২০ শতাংশ। এমনকি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায়ও গত অর্থবছর পণ্য পরিবহনে রেলের আয় বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের মার্কেটিং বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে রেলপথে ভারত থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে। এতে গত অর্থবছর শুধু এ খাতেই রেলের আয় হয়েছে প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা। খাদ্যশস্য, শিল্প কাঁচামাল ছাড়াও ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি হয়েছে রেলপথে। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি পায়। সব মিলিয়ে পণ্য পরিবহনে রেলের আয় অনেক বেড়েছে।
আবার সম্পত্তি ভাড়া খাতেও গত অর্থবছরে বড় অঙ্কের অর্থ যোগ হয়েছে রেলের ভাণ্ডারে।
আয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছর রেলের জমি ভাড়া থেকে আয় হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৯ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর এ আয় ছিল ৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ জমি ভাড়া অর্থাৎ স্টেট খাতে আয় বেড়েছে প্রায় ৯৩ শতাংশ। আর গত অর্থবছর রেলের স্ক্র্যাপ বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৮৮ টাকা, আগের অর্থবছর যা ছিল ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ স্ক্র্যাপ বিক্রি থেকে রেলের আয় বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
সব মিলিয়ে গত অর্থবছর রেলের মোট আয় হয়েছে এক হাজার ১৭০ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর এ আয় ছিল এক হাজার ২০০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর রেলের আয় কমেছে মাত্র ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর রেলওয়ের মোট আয় ছিল এক হাজার ৫৯০ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর রেলের আয় কমেছিল ৩৮৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বা ২৪ দশমিক ৫১ শতাংশ।
যাত্রী ও পণ্য পরিবহন এবং সম্পত্তি, এই তিন খাতে গত অর্থবছর রেলের আয় কমেছে মাত্র দুই দশমিক ৫১ শতাংশ। যদিও করোনার কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ২০১৯-২০ অর্থবছর সংস্থাটির আয় কমেছিল প্রায় ২৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। এদিকে করোনায় যাত্রী পরিবহন খাতে রেলের আয় কমে যাওয়ার পরও অন্যখাতে আয় বৃদ্ধি পাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রেল বিশেষজ্ঞরা।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের প্রকল্প কর্মকর্তা ও রেলবিষয়ক গবেষক মো. আতিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে বিশ্বের কোনো দেশেই রেলের আয় বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ে ছিল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যাত্রী পরিবহন বৃদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তারা। পাশাপাশি গত অর্থবছর পণ্য পরিবহন ও জমি থেকে আয় বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলে রেলের আয় দ্রুত বৃদ্ধি করা যাবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :