দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি

নানা ইস্যুতে সরকারে অস্বস্তি

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২১, ১২:০৯ পিএম
নানা ইস্যুতে সরকারে অস্বস্তি

ঢাকা : দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা, সদ্য বিদায়ী তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এবং র‌্যাবের সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কারণে সরকারে অস্বস্তি বিরাজ করছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকায় সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেক ক্ষেত্রে ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্যসহ অনেক কিছুই সরকার চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এর প্রভাব পড়েছে সব জায়গায়।

তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, কোথাও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েনি। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। কিছু কুচক্রীমহল সরকার ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মিশনে নেমেছে। তারাই  দেশ-বিদেশে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে।       

মহামারি করোনার মধ্যেও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে অসহায়ত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এরপর সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অজুহাতে কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, রান্নার গ্যাস, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ অবস্থায় ভোক্তারা নির্বিকার।

বিশেষভাবে নিম্ন-আয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না।

বাজারের ওপর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা। নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য মাঝেমধ্যে সরকার টিসিবি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে ট্রাকে কিছু পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করলেও তাও অপর্যাপ্ত। সার্বিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সরকারের ভেতরে-বাইরে বড় ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে।

এদিকে নানা বিতর্কিত ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জেরে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো ডা. মুরাদ হাসান ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়াসহ দেশের ভেতরে-বাইরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। গত মঙ্গলবার প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেও যার জের এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। আর মুরাদ হাসানের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য তার কৃতকর্ম সরকার ও আওয়ামী লীগের অনেকটা ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।

প্রসঙ্গত ডা. মো. মুরাদ হাসান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালেও তিনি একই আসনে থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে সরকার গঠনের সময় মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে পাঁচ মাসের মাথায় ওই বছরের ১৯ মে তার দপ্তর পরিবর্তন করে তথ্য প্রতিমন্ত্রী করা হয়।

নানা সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হলেও সবশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পরিবারের এক সদস্যকে নিয়ে মুরাদ হাসান ‘নারীবিদ্বেষী’ বক্তব্য দেন, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে ফাঁস হয় একটি ফোনালাপ।

দাবি করা হচ্ছে, এই কথোপকথনটি ডা. মুরাদ হাসান ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির। ফোনালাপে থাকা চিত্রনায়ক ইমন ইতোমধ্যে সেটি স্বীকারও করেছেন। ফাঁস হওয়া ওই কথোপকথনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। পুরো বক্তব্যে ‘অশ্রাব্য’ কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি জেলায় মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে।

সর্বশেষ কানাডার পর দুবাইয়ে ঢুকতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে সাবেক এ তথ্য প্রতিমন্ত্রী রোববার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকায় ফিরেছেন।

অন্যদিকে র্যাবের ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ঘটনায় র‌্যাব-এর সাবেক প্রধান, বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এ নিষেধাজ্ঞা কেন্দ্র করেও দেশ বিদেশে আলোচনার ঝড় বাইছে।  

যদিও ২০০৪ সালে গঠিত র্যাবের বিরুদ্ধে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগ অনেক পুরনো। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময়ে কঠোর সমালোচনাও করেছে।

তবে বরাবরের মতোই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ১৭ কোটির জনগণের দেশে কিছু অপরাধী ‘থেকেই থাকে’। আর মাদক কারবারিরা নিজেদের রক্ষা করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।

আমাদের প্রশিক্ষিত বাহিনী অভিযান চালালে তারা অস্ত্র ব্যবহার করে এবং গোলাগুলোর ঘটনা ঘটে এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তা ছাড়া প্রতিটি ঘটনা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তদন্ত হয়। কারো কোনো গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সুতরাং ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ কথাটি ঠিক নয় বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেবার ইস্যুটিকে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একটি চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেখেন একজন বিশ্লেষক।

যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের স্কুল অফ সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজের অধ্যাপক সায়ীদ ইফতেখার আহমেদ গনমাধ্যমে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইতোমধ্যে সম্পর্কে প্রভাব পড়েছে। এর পেছনে চীন ও রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক।

কোয়াড নামের এক মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশের যোগ না দেওয়া, এমন নানা কারণে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি বদলের একটি যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি যদি আগামীতে চীন ও রাশিয়ার দিকে আরো ঝুঁকে পড়ে তাহলে ভবিষ্যতে আরো কিছু নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অধ্যাপক সায়ীদ ইফতেখার আহমেদ। পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির কার্যক্রমের ওপর।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন,  সম্পর্কে প্রভাব পড়বে কি না, সেটা ‘ডিপেন্ডস অন ইউএসএ’, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে। তবে বাংলাদেশের কোন নিরাপত্তা বাহিনী ও তার কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা এটাই প্রথম। এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞার কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

এদিকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকা্ল সংঘটিত হয়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সঠিক নয়।

তিনি বলেন, যারা আইনের শাসনে বিশ্বাস করে তাদের একটা কর্তব্য থাকে, সেটা হচ্ছে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা এবং যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাদের আত্মপক্ষ অবস্থানের সুযোগ দিয়ে কথা বলতে দেওয়া।

আমার কাছে যে তথ্য আছে, যাদের বিরুদ্ধে এই স্যাংশন দেওয়া হয়েছে তাদের আত্মপক্ষ শোনা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমি এটাও বলতে চাই, যে দোষে র‍্যাব ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দোষী করা হয়েছে তা ঠিক নয় এবং কল্পনাপ্রসূত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ছয়শোর বেশি লোক অদৃশ্য (গুম) হয়েছেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তকে একপেশে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন লগ্নে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত ও ব্যথিত। মার্কিন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করবে।

কাদের বলেন, র‍্যাব একটি এলিট ফোর্স হিসেবে সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ দমনে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে কাজ করছে। এ বাহিনীর কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। নারায়ণগঞ্জর ঘটনায় র‍্যাবের অন্তত সাত সদস্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। কোনো অভিযোগ থাকলে বাহিনী নিজে কিংবা মন্ত্রণালয় তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ঢালাওভাবে অভিযোগ এনে একটি বাহিনীর প্রধান এবং সাবেক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ অযৌক্তিক। মানবাধিকারের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্তই এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। যাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন বিভিন্ন সিটিতে রাস্তায় নামে, তাদের অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত, এ সিদ্ধান্তের গভীরে বাংলাদেশ বিরোধী কিছু ব্যক্তি বা অপশক্তির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক ও অভিন্ন ইস্যুসহ বহুপক্ষীয় ইস্যুতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করছে দুদেশ।

প্রসঙ্গত মার্কিন রাজস্ব দফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত বিবৃতি অনুসারে, নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বেনজীর আহমেদ ছাড়াও রয়েছেন-র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!