ঢাকা : সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে চলছে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েট ওমিক্রন আতঙ্ক। এবার সে আতঙ্কের ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশে। এখন পর্যন্ত দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছেন ৩০ জন। এ সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ওমিক্রন ছড়িয়ে গেলে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে ফিরে আসাও কঠিন হবে। তবে এ পর্যন্ত যাদের ওমিক্রন শনাক্ত করা হয়েছে তারা সবাই ঢাকা জেলার। এমন তথ্য দিয়েছে জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (জিআইএসএআইডি)।
গতবছর জুলাই-আগস্টের দিকে দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরে কমতে কমতে জুলাই মাসে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে। যা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। গত ৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৫ জানুয়ারি ৪ শতাংশ ছাড়ায়। কিন্তু এর দুইদিন পরই শনাক্তের হার ছাড়িয়ে হয় পাঁচ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ফলে দিনদিন বাড়ছে আতঙ্ক।
ইনফেকশাস ডিজিজের সূত্রে জানা যায়, ওমিক্রন যেভাবে ছড়াচ্ছে এবং তার শনাক্তের হার যদি হিসাব করা হয় তাহলে এটা আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়ার কথা এবং সেটারই ‘ফোরকাস্ট’ হচ্ছে গত এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ওমিক্রনের হটস্পটে পরিণত হতে পারে ঢাকা জেলা। সপ্তাহখানেক ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক সংক্রমণের তথ্যও সে কথা বলছে। ঢাকার পাশাপাশি চরম ঝুঁকিতে রয়েছে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের জেলা। প্রথম করোনার হটস্পটও ছিল ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলো। কিন্তু গতবছরের বিধ্বংসী ডেল্টা দেশে ঢুকেছিল সীমান্তবর্তী জেলাগুলো দিয়ে। পরে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলাতে।
সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন জানান, ঢাকায় ওমিক্রনের ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন (গুচ্ছ সংক্রমণ) হয়েছে। সময়মতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিলে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না।
তিনি বলেন, এটা যখন স্থানীয়দের মধ্যে যাবে তখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে ঢাকার বাইরেও যাবে। আগে ছিল স্পোরাডিক ট্রান্সমিশন (বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন সংক্রমণ)। এখন সেটা ক্লাস্টারে গিয়েছে। এরপর যাবে কমিউনিটিতে। তাই দেশে আইসোলেশন সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ আক্রান্তদের ঘরে রাখতে হবে। তাদের জন্য সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে রোগী বেড়ে যাবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ডেল্টা, ওমিক্রন সব ভ্যারিয়েন্টেরই হটস্পট ঢাকা। ওমিক্রনে এ পর্যন্ত ৩০ জন শনাক্ত হয়েছেন। যাদের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে কেবল তাদের মধ্যে ২১ জন শনাক্ত হয়েছেন।
কেবল সরকারি হিসাবে ঢাকা জেলায় যত মানুষ প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে তাদের নমুনা নিয়ে যদি সিকোয়েন্সিং করা হতো তাহলে হয়তো তারাও ওমিক্রনে আক্রান্ত শনাক্ত হতেন।
ওমিক্রনের কারণে দেশে শনাক্তের সংখ্যা ও হার বাড়ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমি মনে করি এবার ঢাকা শহর ছাড়িয়ে ওমিক্রন পুরো দেশে ছড়াচ্ছে।
তার মতে, ঢাকায় যারা ওমিক্রনে শনাক্ত হলেন, তাদের কি সঠিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন হয়েছে। তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং হয়নি। এই মানুষগুলো কত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। এর সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না গেলে ওমিক্রন সারা দেশে ছড়াতে সময় নেবে না।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ওমিক্রনে আক্রান্তরা সবাই ঢাকার। ঢাকায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। গত একসপ্তাহে শনাক্তদের মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশই ঢাকায়। এবার আবার ঢাকা হটস্পট।
এদিকে, আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, প্রতিদিন রোগী লাফিয়ে লাফিয়ে রোগী বাড়ছে, বাড়ছে শনাক্তের হার। সংক্রমণ ও শনাক্তের হার বাড়ছে। কিন্তু এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে ভালো হতো। সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে রাখা গেলে তাকে সহনশীল বলা যায়।
তিনি বলেন, বর্তমানে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে রয়েছি বলেই জাতীয় কমিটিসহ সবাই যে পরামর্শ দিচ্ছে, সরকার নিশ্চয়ই সে অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু ওমিক্রন ঠেকানো যাবে না, এর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঠেকানো খুব কঠিন। ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি। সেইসঙ্গে করোনায় লক্ষণ উপসর্গবিহীনও থাকেন অনেকে, যা কিনা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে।
ওমিক্রন দেশজুড়ে ছড়িয়ে গেলে আবার ফেরত আসা কঠিন হবে জানিয়ে ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, গত দুই মাস ধরে সব শপিংমল খোলা, বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে, ইনডোরে কনসার্ট হচ্ছে এবং এসবের কোথাও কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এই ভাইরাসটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এবং বিশেষভাবে পরিবর্তিত ভাইরাস যে কোনো সময়ে আমাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে ডা. আলমগীর বলেন, রাষ্ট্র হয়তো শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সরকারের সব অঙ্গ মিলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। কিন্তু শাস্তি দিয়ে আর কতজনকে মানানো যাবে? ব্যক্তিগত সচেতনতাই এখানে সবচেয়ে জরুরি।
একই কথা বলেছেন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. তারিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, এখনই সময়, দেরি হয়ে গেলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে এবং সেখান থেকে ফেরত আসা কঠিন হবে।
ভারতের সংক্রমণ পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই দেশে উদ্বেগ তৈরি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর খোলা রয়েছে। মানুষের যাতায়াত থেমে নেই। আর এ পরিস্থিতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।
তিনি আরো বলেন, পাশাপাশি একটা কথা বলতে আমরা ভুলে যাচ্ছি, সেটা হচ্ছে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের অবৈধ পথেও আনাগোনা আছে। যারা এভাবে চলাচল করে তারা ওপাড় থেকে এপাড়ে ওমিক্রন নিয়ে আসবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। যেটা হয়েছিল ডেল্টার সময়ে। এখানেও তাই হবে।
ওমিক্রন ঠেকাতে জাতীয় কারিগরি কমিটি তাদের বৈঠকে চারটি বিষয়ের ওপর ভীষণ গুরুত্বারোপ করেছে। সেগুলো বাস্তবায়ন না করার কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়সহ সব ধরনের জনসমাবেশ অতিসত্বর বন্ধ করার কথা বলেছি, কোনো সংকোচন নয়। স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য কড়াকড়ি আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে এখানে কাজে লাগতে হবে। যদি মানুষকে সরকার মাস্ক পরতে বাধ্য না করতে পারে তাহলে অনেক ক্ষতি হবে।
দেশে ধাপে ধাপে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলছে। এসব নির্বাচনে স্বাস্থ্যবিধি কতটুকু মানা হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় কারিগরি কমিটির এই সদস্য।
তিনি বলেন, নতুন করে তফসিল ঘোষণা না করার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। নির্বাচনি প্রচারণায় প্রার্থী এবং তার অনুসারীদের মিছিল দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে যার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। আর আমরা হয়তো সেখান থেকে খুব খারাপ জায়গায় পৌঁছাবো।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনার চিত্র ভীষণভাবে ঊর্ধ্বমুখী জানিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখনো সময় রয়েছে, ওমিক্রন ছড়িয়ে গেলে ফেরা যাবে না-এটা প্রতিটি মানুষকে মাথায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :