নির্বাচনের বছরে দুই চ্যালেঞ্জ, জঙ্গিবাদে জিরো টলারেন্স

  • লাইজুল ইসলাম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম
নির্বাচনের বছরে দুই চ্যালেঞ্জ, জঙ্গিবাদে জিরো টলারেন্স

ঢাকা: চলতি বছর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবছরে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। একইসঙ্গে উত্থান হতে পারে জঙ্গিবাদের। রাজনৈতিক সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ একই সঙ্গে মোকাবেলা করা কঠিন হবে বলে মনে করছে তারা। এজন্য সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, নির্বাচনের বছর তাদের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি রাজনৈতিক সহিংসতা আরেকটি জঙ্গিবাদ।এরমধ্যে কড়া দৃষ্টি থাকবে জঙ্গিবাদের ওপর।

সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালত প্রঙ্গণ থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে দুই জঙ্গিকে ছিনতাই করে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। দুই পুলিশ সদস্যের চোখে পিপার স্প্রে ছিটিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়।এই ঘটনায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।

জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১০ আসামিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। মামলার আরেক আসামি জঙ্গি সদস্য ঈদি আমিন আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঈদি আমিনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়।তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে দুই জঙ্গি কোথায় আছে সে বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

এদিকে এই ঘটনায় গঠন করা তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়নি। যদিও পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নেয় পুলিশ। তবে জঙ্গিরা কোথায় পালিয়ে আছে তা এখন পর্যন্ত জানাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। 

এরই মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় ইতোমধ্যে গত বছর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন বিএনপি কর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি। কোনো পুলিশ সদস্য নিহত না হলেও আহত হয়েছেন শতাধিক।

গেলো বছর ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির গণমিছিলে ঢুকে পড়ে জামায়াত-শিবির। আলাদা মিছিল বের করে তারা। অনুমোদন না নিয়ে মিছিল করায় বাঁধা দেয় পুলিশ। এসময় জামায়াত-শিবিরের হামলায় আহত হন ১০ পুলিশ সদস্য। ডিএমপি কমিশনার তাদের দেখতে গিয়ে বলেন, জামায়াত-শিবির আবারও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এটা হতে দেয়া হবে না।তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এই যখন পরিস্থিতি তখন খুব দ্রুতই এগিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ক্ষমতায় না থাকা দলগুলো। এর মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দলগুলো তাদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। রাজধানীতে মিছিল সমাবেশ করছে। দেশের ক্ষমতায় থাকা দলটিও তাদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করছে। এতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে দেশের ভেতরে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহীনিকেও বিশেষ নজর দিতে হচ্ছে রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ ও মিছিলগুলোতে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে তাদের। 

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ ছিলো। সেসময় ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর দেশে আসে তামিম চৌধুরী। দেশে তৈরি করেন ‘জুনুদ আল তাওহিদ’। এতে ভালো সাড়া না পেয়ে জেএমবির পুরোনো সদস্যদের নিয়ে তৈরি করেন নব্য জেএমবি।তিনিই ছিলেন এই জঙ্গি সংগঠনের মাষ্টার মাইন্ড। তার নির্দেশনায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে। যেটা বাংলাদেশের জন্য ছিলো কলঙ্কিত অধ্যায়। এরপর পুলিশ তাদের শক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু হঠাৎ করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা বেশ চিন্তার সঞ্চারণ ঘটিয়েছে।  

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এবছর রাজনৈতিক সহিংসতার আড়ালে একত্রিত হতে পারে জঙ্গিরা। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচীতে পুলিশ বাঁধা দেবে না। যারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সভা-সমাবেশ করবে তাদের সহযোগিতা করবে পুলিশ। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, রাজধানীতে মানুষের সমস্যা হয়, যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এমন স্থানে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। তবে এর বাইরে যারাই শান্তিপূর্ণ ভাবে সভা-সমাবেশ করবে তাদের সহযোগিতা করবে পুলিশ। 

এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কেন্দ্রীক রাজনৈতিক সহিংসতা যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ রেখে ইতোমধ্যে পুলিশ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। 

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিরোধী দল ও ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কিছু নেতাদের ওপর নজরদারি চলছে। তারা বিভিন্ন সময় সহিংসতার পিছনে ইন্ধন দিয়েছেন। এখন আরো কিছু নেতাকে নতুন করে নজরদারিতে আনা হচ্ছে।

এদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো ভাবেই যাতে জঙ্গিরা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সাইবার জগতে ব্যপক ভাবে কাজ চলছে। যেসব তরুণ-তরুণীরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাসা ছেড়ে বেড়িয়েছে তাদের একটি তালিকা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি তালিকা করে তা প্রকাশও করা হয়েছে। তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি। 

সাবেক আইজিপি নিরাপত্তা বিশ্লেষক নুরুল আনোয়ার বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহীনির সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি রাজনৈতিক সহিংসতা আরেকটি জঙ্গিবাদ। রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেলে জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই দুটিকে এক সঙ্গে প্রতিহত করতে হবে। সব সংস্থা বা বাহীনিকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। 

তিনি বলেন, পুলিশ এখন পুরো দেশ জুড়ে নিরাপত্তার ছক আঁকবে।যারা কোনো ভাবে হামলা বা সহিংসতা করতে পারে তাদের নজরদারিতে আনতে হবে। দিন দিন যত সময় যাবে ততই হামলা বা রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়বে। আর এই সহিংসতা বাড়াতে কাজ করছে জনগণের মধ্যে মিলেমিশে থাকা কিছু মানুষ। তাই সাইবার নজরদারিও বৃদ্ধি করতে হবে।

রাজনৈতিক সহিংসতা জুন-জুলাই মাসে বাড়তে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বাড়তে পারে। সহিংসতা বাড়তে পারে এপ্রিল থেকে। জুন-জুলাই মাস পর্যন্ত একটা ধারনা করা যায় যে রাজনৈতিক সাহিংসতা বাড়তে পারে। তবে এর পর কি হবে তা এখন পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।

এদিকে, যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছড়ায় তারাই আবার জঙ্গিবাদকেও বাহবা দেয়। এই সময়ে পুলিশ যখন সহিংসতা বন্ধে কাজ করবে তখন আরেকটি গ্রুপ জঙ্গিবাদকে মদদ দিতে পারে।তাই সিটিটিসি ও র‌্যাবকে একত্রে জঙ্গি দমনে কাজ করতে হবে। যাতে কোনো ভাবেই জঙ্গিবাদকে নতুন করে সংগঠিত হতে সহায়তা করতে না পারে।

কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান সম্প্রতি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই বছর আমাদের দৃষ্টি শুধু জঙ্গিবাদের ওপরই থাকবে।তাদের (জঙ্গি) নিয়ে আমাদের এবছরের চিন্তা জিরো টলারেন্স। এই নীতিতেই আমরা কাজ শুরু করেছি। 

তিনি বলেন, দেশের নীতিও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। এবার জঙ্গিবাদকে আমরা নির্মূল করার চেষ্টা করবো। যদি তা করতে না পারি তবে অন্তত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো বলে আশা করি।  

র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মাঈন সোনালীনিউজকে বলেন, গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি সাইবার ওয়ার্ল্ডে আমাদের বিচরণ সব সময় আছে। কোনো সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাতে এই গোষ্ঠি হামলা বা অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে আমাদের নজর রয়েছে। তাদের রুখে দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। 

তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে আসছে। সেটা নিয়ে আমদের প্রস্তুতি আছে। যারা বাসা থেকে পালিয়েছে তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে আমরা আইনের আওতায় আনতে পেরেছি। বাকিদের খুঁজছি। আশাকরি তাদেরকেও আমরা আইনের আওতায় আনতে পারবো। কোনো ভাবেই যাতে রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে জঙ্গিরা মথাচাড়া দিতে না পারে সেদিকে আমরা কঠোর ভাবে নজর রাখছি।

সোনালীনিউজ/এলআই/আইএ

Link copied!