ঢাকা: রাজধানীর চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে চারটি নদী। দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। এই নদীর আদি চ্যানেল উদ্ধারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু এই উদ্ধার কার্যক্রমের পরও নদীর কিছু অংশ এখনো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করেই উচ্ছেদ করা হয়নি বলে দাবি করেন স্থানীয়রা। এমনকি আদি চ্যানেল একদিকে উদ্ধার হলেও অন্যদিকে এখনো ভরাট রয়েছে। ময়লা ফেলে সেসব অংশ ভরাট করেছে খোদ সিটি করপোরেশন।
সিকশন ঢালে দাঁড়িয়ে আদি বুড়িগঙ্গার ওপর তাকালে দেখা যায় একটি ব্রিজ কামরাঙ্গীরচর ও ঢাকাকে সংযোগ করেছে। এই সেতু উত্তর-দক্ষিণ মুখি। আর আদি বুড়িগঙ্গা গিয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। সিকশন বেড়িবাঁধ ঠিক থাকলেও সামনের দিকে হাটলেই দেখা যায় নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুতের পাওয়ার স্টেশন, পার্ক ও বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। বিদ্যুৎ বাদে সবই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এইসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা হয়নি বলেই সাধারণ মানুষের অভিযোগ।
অভিযোগকারীদের প্রশ্ন, তোদের বাড়ি ভাঙা পরেছে, কিন্তু এসব স্থাপনা কেনো ভাঙা হলো না?
সরেজমিনে সিকশন ঢালে গিয়ে দেখা যায়, সিকশন বেড়ি বাঁধ ও ব্রিজ সংলগ্ন উত্তর পাশের দখল হয়নি। তবে কিছুটা সামনে এগিয়ে দেখা যায় বেড়িবাঁধের পাশে নদী দখল করে গড়ে উঠেছে বিদ্যুতের পাওয়ার স্টেশন। এই স্টেশনের পাশে আরো অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পার্কও গড়ে উঠেছে নদীর জায়গা দখল করে। এই সব কিছুই নদীর মধ্যে পরেছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
বুড়িগঙ্গা নদীর এক পাশে দখল করে তৈরি করা স্থাপনা প্রায় সবই ভেঙ্গে দিয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে এখন উচ্ছেদ হওয়া স্থানগুলো আবারও দখলের চেষ্টা করছে স্থানীয়রা। নদীর পাশে বালু ফেলে রাস্তা করার চিন্তা করছে সিটি করপোরেশন। এতে নদী আর দখল হবে না বলে মনে করে সিটি করপোরশেন। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু লোক চাইছে বালু ফেলা স্থানের পাশেই নিজেদের জন্য কিছু জায়গা দখল করে নিতে।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, নদীর মধ্যে এখনো ময়লার স্তুপ। এসব ময়লা আবর্জনা বাসাবাড়ি থেকে নিয়ে এসে এখানে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন কারখানার আবর্জনাও ফেলা হয়েছে এখানে। নদীর মধ্যে এতটাই ময়লা জমেছে যে সড়কের সমান উচুঁ হয়ে গেছে। এসব ময়লা আবর্জনা সরাতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে হবে বলে মনে করেন পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।
কামরাঙ্গিরচরের নদীর পাশে বাড়ি আছে এমন একজন সোনালীনিউজকে বলেন, এখানে কথা বলাও নিষেধ। আমাদের কাছে কাগজ ছিলো তারপরও বাড়ি ভাঙ্গা হয়েছে। বাড়ির অর্ধেক চলে গেছে এই নদীর মধ্যে। যখন কিনেছি তখন আর কেউ এই কথা বলেনি। আমরা নিয়মিত খাজনাও দিয়েছি। এখন আমাদেরটা ভাঙলেও নদীর অপরপাশের অংশ ভাঙা হয়নি। সরকারও তো নদী দখল করে বিদ্যুতের পাওয়ার স্টেশন তৈরি করেছে। পাওয়ার স্টেশনের পাশে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। সেগুলোও ভাঙা হয়নি।
নদীর মধ্যে পরে যাওয়ায় তিন তলা ভবনের অর্ধেকের বেশি ভাঙা হয়েছে। সেই বাড়ির অংশীদার বলেন, আমাদের এই বাড়ি করার সময় বিভিন্ন ভাবে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। কিন্তু তখন কোনো কিছুই পাইনি। এখন নাকি ডিজিটাল ম্যাপ করা হয়েছে। সেই ম্যাপে আমাদের বাড়ি পরেছে। আর এখন ভেঙে ফেলা অংশগুলো অন্য লোক দখল করার চেষ্টা করছে। এই দখলের চেষ্টা যারা করছে তারাই বাড়ি ভাঙার সময় কাজ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব রহমত আলী বলেন, এই নদী দিয়ে আমরা এক সময় বড় বড় নৌকা চলতে দেখেছি। এখানে মাছও ধরেছি আমরা। বাঁধ দেয়ার পর নদীতে কিছুটা স্রোত কমলেও নদী মরেছে মূলত আমাদের অবহেলার কারণে। এখানে এনে ঢাকার সব ময়লা ফেলা হয়েছে। দেখেন এখানে কত ময়লা পরে আছে। সব পলিথিন আর প্লাস্টিক। এগুলো রাজধানীর ভেতর থেকে এনে এখানে ফেলা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এই ময়লা আবর্জনার কারণে নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে। ময়লা পরিস্কার করার কারো উদ্যোগ নেই। আছে শুধু দুই পাশে ভাঙচুর করার ক্ষমতা। এই ভাঙচুর করেই বা কি লাভ এসেছে। যে পরিমান ময়লা চাইলেই সরাতে পারবে না। এখানে একদিনে এত ময়লা জমে নাই। নদীই নষ্ট হয়ে গেছে এই প্লাস্টিক ও আবর্জনায়।
রাজধানীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন সোনালীনিউজকে বলেছেন, আদি বুড়িগঙ্গা কোনো ভাবেই দখল হতে দেয়া হবে না। যা উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে আর কাউকে দখল করার সুযোগ না দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে পুলিশের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত স্থানগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে সিটি করপোরেশন সীমানা চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছে।
তিনি বলেন, আদি বুড়িগঙ্গা উদ্ধারে আমাদের কয়েকটি ফেইজে কাজ চলছে। প্রথম ফেইজে উদ্ধার কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা উদ্ধার করেছি নদীর পাশের অনেক জমি। নদীর দখলকৃত আরো জমি উদ্ধারে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের সার্ভেয়ার ও জেলা প্রশাসনের সার্ভেয়ার মিলে নদীর দখল হওয়া অংশ উদ্ধার করছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীর দখল হওয়া অংশ উদ্ধার করা হয়েছে।
প্রভাবশালীরা আবারও দখল করার চেষ্টা করছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এবার কঠোর হয়েছেন। কোনো ভাবেই উদ্ধার হওয়া নদীর অংশ যাতে দখল না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে।
সিকশন মোড়ের পাশে বুড়িগঙ্গার অর্ধেকের বেশি ময়লার স্তুপে ভরে আছে, এটা কিভাবে ঠিক করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নদীর মধ্যে জমে থাকা ময়লা, আবর্জনা ও পলিথিন সরানো হবে। এজন্য বাজেটও পাওয়া গেছে। পুরো নদীতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে আমরা কার্যক্রম শুরু করবো। আগামী বর্ষায় যাতে পানি প্রবাহ হয় সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। কালুনগর খাল থেকে পুরোটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করি।
নদীর জায়গার মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের স্থাপনাসহ অন্যান্য স্থাপনার বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার স্টেশন সরানোর দায়িত্ব সরকারের। এটি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে সরকার। মেটাডোর, পার্ক ও অন্যান্য স্থাপনার জমি মাপার পর নদীর ভেতরে চলে আসা স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। সেখানে ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অ্যধাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এই উদ্ধার অভিযান পুরোপুরি সফল করতে আগে থেকে আরো স্ট্যাডি করা প্রয়োজন ছিলো সরকারের। এক পাশে উদ্ধার করেছে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অন্যপাশে সরকারের বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এই অবস্থায় পুরোটা উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। আর নদীতে পাহাড়সম যে ময়লা ফেলা হয়েছে তারও দ্বায় সিটি করপোরেশন এড়াতে পারে না। এখন এগুলো সরিয়ে নদীর মূল প্রবাহ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পরবে সিটি করপোরেশনের জন্য।
সোনালীনিউজ/এলআই/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :