ঢাকা : রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, একটি টিকিটও এনআইডি ছাড়া বিক্রি হবে না। কিন্তু এটা কতটা সম্ভব? এই প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে। বিস্তর অভিযোগ ও নাখোশ যাত্রীরা। যারা ট্রেনে চরেন তারাই এই প্রক্রিয়ার বিরোধীতা করছেন। তবে কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন টিকিট বিক্রির নতুন এই সিদ্ধান্তকে। মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই ১ মার্চ সকাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ট্রেনের টিকিট বিক্রি কার্যক্রম।
জানা গেছে, আন্তনগর ট্রেনের টিকিট কেনার আগে প্রত্যেক যাত্রীকে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর বা জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কাউন্টার, অনলাইন ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে টিকিট কেনা যাত্রীদের অনলাইন অথবা মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে রেলওয়ের টিকিটিং সিস্টেমে নিবন্ধন করতে হবে।
রেলওয়ে সূত্র আরো জানায়, যাত্রীরা গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও পাসপোর্টের মাধ্যমে রেলওয়ের সিস্টেমে নিবন্ধন করতে শুরু করেছেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার জন্য ইতোমধ্যে বড় বড় স্টেশনে একটি করে হেল্প ডেস্কও রাখা হয়েছে। এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষ কিছু শর্তও যুক্ত করে দিয়েছে। ১২-১৮ বছর বয়সী যাত্রীরা তাদের বাবা-মায়ের এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন করা রেলওয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে এককভাবে টিকিট কিনতে পারবে। তবে এসব ক্ষেত্রে টিকিটের ওপরে লেখা নামের সঙ্গে যাত্রীর সম্পর্ক যাচাইয়ের জন্য ভ্রমণের সময় অবশ্যই জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি সঙ্গে রাখতে হবে। বিদেশি নাগরিকরা পাসপোর্ট নম্বর প্রদান ও পাসপোর্টের ছবি আপলোড করার মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবেন।
তাছাড়া এনআইডি, পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন ছাড়া কোনো যাত্রী আন্তনগর ট্রেনের টিকিট ক্রয় করতে পারবে না। ভ্রমণকালে যাত্রীকে অবশ্যই নিজস্ব এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি অথবা পাসপোর্ট বা ছবি সম্বলিত আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে। পরিচয়পত্রের সঙ্গে টিকিটের ওপরে লেখা যাত্রীর তথ্য না মিললে যাত্রীকে বিনা টিকিটে ভ্রমণের দায়ে অভিযুক্ত করা হবে।
সোনালীনিউজের সঙ্গে কথা হয় রেলের বেশ কয়েকজন টিকিট চেকারের সঙ্গে। তারা এই প্রকিয়াটিকে বেশ জটিল ও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। যদিও এসব কথা তারা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেছেন। টিকিট কাউন্টার থেকে ক্রয়ের সময় বা অনলাইনে টিকিট কাটা প্রথম দিকে বেশ সমস্যায় পরতে হবে যাত্রীদের বলে জানিয়েছেন তারা। তাই হঠাৎ করে প্রতিটি আন্তনগর ট্রেনে এই কার্যক্রম শুরু না করে ধীরে ধীরে এই ধারা শুরু করলে ভালো হতো বলে মনে করেন টিটিরা।
রেল কর্তৃপক্ষ এবার পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিন যুক্ত করতে যাচ্ছে ট্রেনে। এতে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ বন্ধ হবে। ১ মার্চ থেকে প্রায় ১০০টি মেশিনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। এজন্য টিটিদের ট্রেনিংও দেয়া হয়েছে। এতে বিনা টিকিটের যাত্রীদের যেকোনো জায়গা থেকে অনলাইন বা অফলাইনে নগদ বা ক্যাশ প্রদানের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করা সম্ভব হবে। এতে রেলের রাজস্ব বাড়বে। ট্রেনের টিকিট চেকিং ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে।
এদিকে এই মেশিনটির মাধ্যমে টিকিট অনলাইন বা কাউন্টার থেকে কাটা হয়েছে সেটা যাচাই করা যাবে। একই সঙ্গে জাল টিকিট যাচাই করা যাবে। এই মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে বিনা টিকিটের যাত্রী, জরিমানা ও ভাড়ার হিসাবের স্বচ্ছতা আসবে। পিওএস মেশিনে জিপিএস থাকায় টিটিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহীর বাসিন্দা আনোয়ারুল হক রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে অন্তত দুই বার আমি বাড়ি যাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে। হঠাৎ এই ব্যবস্থায় বেশ বেগ পেতে হবে। আমি আমার টিকিট কাটতে কাউকে পাঠাতে পারবো না। যদি সে কোনো কারণে ভুল করে বসে তবে তো আমি যাত্রা করতে পারবো না। আবার অনলাইনে টিকিট কাটা বেশ ঝামেলার। এটা সবাই জানে অনলাইনে কি কি ঝামেলা হয়। এটাতে উপকারের চাইতে ঝামেলাই বাড়বে বলে আমি মনে করি।’
কাউন্টার মাস্টারকে এ বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘এই নতুন বিষয়টি নিয়ে কাউন্টারেও বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পরতে হচ্ছে আমাদের। ১ মার্চ থেকে বিক্রি শুরু হলে বোঝা যাবে কি হয়। সবার এনআইডি নাই, অনেকে এনআইডি সঙ্গে রাখেন না। আবার অনেকে বোঝেন না বিষয়টি কিভাবে হবে। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই পরে আছি। তবে আশা করি নতুন এই সিদ্ধান্ত সবার জন্য ভালো হবে।’
এদিকে, খুলনার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমার জন্য এটি একটি ভালে সিদ্ধান্ত। আমি আমার টিকিট কাটবো। আমার নামে সব কিছু থাকবে। আমি সিটে গিয়ে বসবো। আমিই জার্নি করবো। এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বাইরের দেশগুলোতেও এরকম নিয়ম আছে। আমি এটাকেই সমর্থন করছি। দালালদের দৌরাত্বে কখনোই সঠিক দামে ও ইচ্ছে মতো টিকিট কাটা যেতো না। আমার নিবন্ধন থাকবে ওয়েবসাইটে। আমি নিজের মতো করে ইচ্ছে মতো টিকিট কেটে নিবো। এখানে কাউন্টারেও এক ধরনের ঝামেলা কমবে। কষ্ট করে কাউন্টার পর্যন্ত যেতে হবে না। বাসায় বসে অনলাইনে টিকিট কাটতে পারবো। ’
গত বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রেলভবনে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ে টিকিট ক্রয়ে এনআইডি ও জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং পস ডিভাইস সংযোজন সংক্রান্ত এক সেমিনারের পর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তখন সংবাদ সম্মলনে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের নিকট হতে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে টিকিটিং ব্যবস্থায় তিনটি সেবা অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছে। যা আগামী ১ মার্চ হতে কার্যকর হবে। এরমধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটিং ব্যবস্থা, টিকিট চেকিং ব্যবস্থায় পস (পয়েন্ট অব সেলস) মেশিনের প্রবর্তন এবং অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়কৃত টিকিট অনলাইনে রিফান্ডের ব্যবস্থা।’
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে রেলের উন্নয়নে। কিন্তু কোনোটাই সফল হতে পারেনি। এর আগেও এনআইডি দিয়ে রেলের টিকিট বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সেটা মুখ থুবরে পরে কয়েকদিন পরেই। শর্ষের ভেতরে ভূত আছে। এখানেও সেটা। যদি টিকিটিং ব্যবস্থা ভালো হয় তবে খুবই ভালো। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আরো বেশ কিছু সমস্যা সমানের দিকে আসতে পারে। সেগুলোকে নজরে নিয়ে পদ্ধতি উন্নয়ন করতে হবে। এখানেই থেমে থাকলে হবে না। নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গেলে কিছু সমস্যায় পরতে হবে। তাই এই কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে রেলের কর্মীদের সদিচ্ছাও থাকতে।’
সোনালীনিউজ/এলআই/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :