ঢাকা : সরকারের পদত্যাগ ও তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে বিএনপির চলমান আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে নানা কৌশল অবলম্বন করছে দলটি।
বিএনপির নেতারা বলছেন, এ জন্য রাজপথের আন্দোলনের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে তা সমাধান করা, এক নেতা গ্রেপ্তার হলে অন্য নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দলটির নেতারা বলেছেন, সময়মতো দলের হাইকমান্ডের সিগনাল পেলে সবাই একযোগে মাঠে নামবেন তারা।
গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর এক দিনের হরতালের পর পাঁচ দফায় ১১ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।
রোববার (১৯ নভেম্বর) থেকে আবার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি চলছে। এসব আন্দোলনে বিএনপির সমমনা দলগুলোও মাঠে আছে।
দলটির একাধিক নেতা বলেন, আমরা এখন সরকার পতনের সর্বাত্মক কর্মসূচিতে রয়েছি। সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলতে থাকবে। আন্দোলনে সফলতা আসবে কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে আন্দোলন সফল করতে নানাবিধ কৌশল আমরা অবলম্বন করছি।’
তারা বলেন, জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকারসহ সব ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চলমান আন্দোলনে জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তির বিষয়টি মাথায় রেখেই কর্মসূচি ঘোষণা করছে বিএনপি। অতীতে আওয়ামী লীগ যেভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে জনগণ, ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব করেছে, কষ্ট দিয়েছে, সেদিকটি তারা মাথায় রাখছেন।
আন্দোলন সংগ্রামের কৌশল সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ১৪ বছর ধরে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন। বিগত দিনের আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে চলমান আন্দোলনের ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রতিমুহূর্তে মূল্যায়ন করছেন তারা।
গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পন্ড করে দেওয়ার পর জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার কারণে বাকি নেতাদের আত্মগোপনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন কেন্দ্র ও জেলার দায়িত্বশীল নেতারা আত্মগোপনে থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দিয়ে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করাচ্ছেন। কে কখন কোথায় কীভাবে নামবেন তার ছক আঁকা হচ্ছে। হাইকমান্ডের সিগনাল এলে চতুর্দিক থেকে সবাই একযোগে মাঠে নামবেন।
তিনি বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। এ কারণে নিত্যনতুন কৌশল নিতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে তা মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দল ভাঙার যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। কাউকে কোনো প্রলোভন কিংবা ভয়ভীতি দেখানো হলে তা কেন্দ্রে জানাতে বলা হয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর কমিটির অন্য নেতারা কাজ করছেন। কৌশলগত কারণে কে কাজ করছেন তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে অন্য ক্ষেত্রে জেলা কিংবা এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিএনপির দপ্তর সংশ্লিষ্ট এক নেতা বলেন, ‘আমাদের কাছে যেভাবে নির্দেশ আসে সেভাবে আমরা কাজ করি। জেলা নেতাদের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের নির্দেশনা এলে আমরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দিই।’
তিনি জানান, দুই-এক দিনে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম কারাগারে থাকায় জেলা বিএনপির সহসভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গতকাল।
বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক কারাগারে থাকায় জেলা বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আলী হায়দার বাবুলকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এভাবে একদিকে আন্দোলন চলতে থাকবে এবং অন্যদিকে সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের চেষ্টা চলতে থাকবে আন্দোলনে সফল না হওয়া পর্যন্ত।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমার মোবাইল নম্বরে ফোন করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ প্রয়োগ করছেন। রাজি না হওয়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। রাজনীতির বাইরে থাকা স্বজনদের হয়রানি করা হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে দলের হাইকমান্ডকে জানিয়েছি।’
সরকারের অধীনে কীভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে বলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাজি হলে তৃণমূল বিএনপি কিংবা অন্য কোনো দলের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, চলমান আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ রাখা হচ্ছে।
এ জন্য শুরু থেকে আন্দোলন সংগ্রামে বিরতি দেওয়া হচ্ছে; বিশেষ করে টানা হরতালের কারণে পণ্য পরিবহনে যাতে সমস্যা না হয় এবং মানুষ তার জরুরি প্রয়োজনে যাতে দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে পারে, সে জন্য শুক্র ও শনিবারের পাশাপাশি কার্যদিবসের এক দিন হরতালমুক্ত রাখা হচ্ছে। তবে সিগনাল এলে সবাই যখন একযোগে নামবে, তখন হয়তো বিরতি দেওয়া সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে। কোনো বিরতি দেয়নি। তখন ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে কর্মসূচি বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তিনি তখন সাড়া দেননি। কিন্তু বিএনপি আন্দোলনে বিরতি দিচ্ছে। সব দায়িত্ব তো বিএনপির নয়।
বিএনপি টানা কর্মসূচি দিয়ে এলেও নেতাকর্মীদের খুব একটা রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। ঝটিকা মিছিল করে তা ছবি বা খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সটকে পড়ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সহবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল বারী ড্যানি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে ঝটিকা মিছিল করতে হচ্ছে। তাতেই তো কাজ হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার চেয়ে মফস্বলে সফল হরতাল হচ্ছে। আমার নিজ জেলা নেত্রকোনায় সফল হরতাল হচ্ছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই আন্দোলন চলবে। সময় হলে আমরা সবাই একযোগে মাঠে নামব।’
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :