মানবাধিকার

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও তীব্র হওয়ার শঙ্কা

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০২৩, ০২:০৭ পিএম
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও তীব্র হওয়ার শঙ্কা

ঢাকা : স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি। অসহিষ্ণু রাজনীতির প্রতিহিংসা ও সংঘাতে মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমেই মলিন হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে বিরোধীপক্ষের নেতাকর্মীদের নামে অব্যাহত মামলা, হয়রানি, গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার মতো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে দেশ-বিদেশে। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে।

রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মী, পুলিশসহ নিরীহ মানুষের। তেমনি কারাবন্দি কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে চিকিৎসা, বিরোধী নেতাকর্মীদের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা, গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িছাড়া হওয়া, আসামিকে না পেয়ে বাবা, মা ও স্বজনদের আটক কিংবা গ্রেপ্তারের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মানবাধিকারকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, রাজনীতির বিভেদে অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ধারার আরও অবনতি কিংবা তীব্র হবে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ পালিত হচ্ছে।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন থেকে এক মাসের কিছু বেশি সময় বিএনপি, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ৭৩ হাজার ১২৩ জনকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ হাজার নেতাকর্মীকে।

এ ছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দেড় লাখের বেশি মামলায় দলটির ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে বলে দাবি করেন আইনজীবীরা।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যমতে, ১১ মাসে রাজনৈতিক মামলায় ৮ হাজার ২৬৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ হাজারের বেশি বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী। একই সময় ১৩ হাজার ৮০৮ জনের নামে মামলা হয়েছে। যাদের প্রায় সবাই বিএনপি নেতাকর্মী।

আইনজীবীদের তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অন্তত ৫ থেকে ১২ বছরের পুরনো নাশকতার ৪০ মামলায় গত তিন মাসে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় ৭০০ নেতাকর্মীকে বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আওতায় আনা হয়েছে। যেখানে মৃত, ‘গুম’, ‘নিখোঁজ’ নেতাকর্মীদেরও সাজা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এইচআরএসএসের হিসাবে, গত ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৮০৭টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ৮২ জন নিহত ও ৮ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মধ্যে। এ ছাড়া বিএনপির মহাসমাবেশ, পদযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরেও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এমন একটি রাজনৈতিক দল নেই যাদের মধ্যে দেউলিয়াত্ব নেই। নীতিহীন রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, মৌলবাদী, খেলাফতপন্থি ও স্বৈরাচারের দলের সঙ্গেও আপস হচ্ছে। কেউ নির্বাচন করবে, আর কেউ ঠেকাবে। এর নেতিবাচক প্রতিফলন তো সাধারণ মানুষের ওপর পড়বেই।’

এমন পরিস্থিতিকে একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করে এই আইনজীবী বলেন, ‘মানবাধিকারের সব স্তরেই হতাশার চিত্র এবং সামনের দিনগুলোতে আশান্বিত হওয়ার মতো কিছু নেই।’

পরিস্থিতি এখন ‘একটা কমলে একটা বাড়ে’ এমন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম হয়তো কমছে। কিন্তু রাজনৈতিক মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানি চলছে। বিরোধীপক্ষের ওপর হামলা, মামলা, সাজা অতীতেও হয়েছে। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে সামনের দিনগুলোতে এটি তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন এইচআরপিবির (হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘রাষ্ট্রের সবাই মিলে যার যার অবস্থানে সঠিকভাবে চললেই শুধু মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো থাকে। কিন্তু রাজনীতিতে যদি বিভক্তি থাকে এবং বিভক্তির রাজনীতিতে যদি নির্বাচনের মতো বড় আয়োজন থাকে, তখন মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়। যেটা এখন হচ্ছে।’

তবে, যারা সরকারে থাকে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেননা তাদের কাজটি প্রশাসনই অনেকটা সহজ করে দেয়।’

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এখন এক দলের ওপর আক্রমণ, মামলা, গ্রেপ্তার, বিচার চলছে। আবার বিরোধীপক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করবে। নির্বাচনে সরকারি দলের ডামি প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আছেন। সে ক্ষেত্রে সরকারি দলের মধ্যেও হানাহানির আশঙ্কা থাকবে। তাই খুব ভালো পরিস্থিতি আশা করা যায় না।’

ভালো নেই নারী ও শিশু অধিকার পরিস্থিতি : মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রকাশিত তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগের বছরগুলোর তুলনায় ধর্ষণ ও শিশু হত্যা কিছু কমেছে। তবে, গত চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এ সংখ্যা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে, নিয়ন্ত্রণে কখনো আসেনি।

আগামী নির্বাচন ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে নারী ও শিশু অধিকারকর্মীদের ভাষ্য, নানাভাবে সোচ্চার ভূমিকার পরও ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে না আসার বড় কারণ বিচারহীনতা বা বিলম্বে বিচারপ্রাপ্তি। এর মধ্যে নির্বাচন ও রাজনীতি ঘিরে গত কয়েক মাস পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ততা শঙ্কা বাড়াচ্ছে নারী ও শিশু অধিকারকর্মীদের। কারণ এ সময় মানবাধিকারের এ দিকটিতে তদারকির ঘাটতি হবে বলে তাদের ধারণা।

আসকের হিসাবে চলতি বছরের ১১ মাসে ৫৩৯ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যদিও ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৩৬। ২০২১ সালে করোনাকালে ১৩২১ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে ৪৫৬ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ২০২২ সালে হত্যার শিকার হয় ৬১৬ শিশু। একই সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় চার বছরে সারা দেশে ৫ হাজার ২০৯ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একই সময় ২ হাজার ১৫০ শিশু খুন হওয়ার তথ্য দিয়েছে আসক। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৫৮৯, ২০২১ সালে ৫৯৬, ২০২২ সালে ৫১৬ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।

যদিও গণমাধ্যম ও নিজস্ব সূত্র থেকে দেওয়া এসব তথ্যের চেয়ে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি বলে মনে করেন নারী ও শিশু অধিকারকর্মীরা। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আসলে সংখ্যাগত পার্থক্য দিয়ে নারী ও শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার চিত্র সঠিকভাবে উঠে আসে না। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘নারী ও শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিচার পেতে ভুক্তভোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পাশাপাশি বিচার পেতে দেরি হয়।’

রাজনীতি ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব সময়ই মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু অবনতি হয় জানিয়ে অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েক মাস ধরে ব্যস্ত সময় পার করছে। এ সময় ভুক্তভোগী নারী ও শিশুর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তেমন করে নজরদারি থাকে কি না এটাই আমাদের শঙ্কা।’

আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের ওপর সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী রাষ্ট্রের একজন নাগরিক স্বাধীনভাবে চলাফেরা, মতপ্রকাশ করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাওয়া ও দৈহিক নিরাপত্তার মতো মানবাধিকার ভোগ করেন। ১৯৫০ সালে এই দিনটিকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করবে। আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। সূত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Link copied!