ঢাকা : সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারাদেশে কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি মাঠে রয়েছেন সশস্ত্র বাহিনী ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে নিরাপত্তা টহল ও তল্লাশি। সেই সঙ্গে সাদা পোশাকে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। গুজব ঠেকাতে অনলাইনেও চলছে নজরদারি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোটকেন্দ্র ঘিরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনী সজাগ রয়েছে। তারা সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি রেখেছে। তবে কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে।
এদিকে, মাগুরায় ছাত্রদলের এক নেতাকে গ্রেপ্তারের পর নির্বাচনের দিন একটি গোষ্ঠীর নাশকতা ও সহিংসতার পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তিনি বলেন, নাশকতার চেষ্টা করলে ফল ভালো হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ওই সংবাদ সম্মেলনে পুলিশপ্রধান আরও বলেন, তারা একটা পরিকল্পনা করেছিল, বিকট আওয়াজ করে, ককটেল চার্জ করে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করবে। তথ্য পাওয়ার পর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যারা যত পরিকল্পনাই করুক, সবকিছুই মোকাবিলা করা হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সব বাহিনী মিলে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে থানা পুলিশ বা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সেবা নিতে পারেন। ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
ভোট গ্রহণের দিন বিএনপির ডাকা হরতালের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, দেশের মানুষ নির্বাচনমুখী, নির্বাচনের জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে আছে। তারা দলে দলে কেন্দ্রে যাবেন। হরতালকারীদের খুব একটা পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, এ রকম কাজ করার কোনো সুযোগ তারা পাবে না।
ভার্চুয়াল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানোর বিষয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সাইবার ওয়ার্ল্ডে আমাদের বিভিন্ন ইউনিট নজর রাখবে। আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো কাজ করছে। সাইবার ওয়ার্ল্ড, সাইবার স্পেস– সব জায়গায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।
ঝুঁকিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সব কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখেছি।
মাগুরায় ছাত্রদলের নাশকতার ছক : মাগুরা প্রতিনিধি জানান, ভোটকেন্দ্রে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মোহাম্মদ সজীব শেখকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মশিউদ্দৌলা রেজা জানান, বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে নিজ বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ ও তাঁর মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রভিত্তিক নাশকতার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়।
তাঁর মোবাইলের গ্রুপ কল থেকে জানা যায়, বিএনপির সব নেতাকর্মীকে ঢাকা থেকে মাগুরায় চলে আসা, হরতাল জোরদার করা, নির্বাচনের দিন ভোটার যেন কেন্দ্রে যেতে না পারে– সে লক্ষ্যে ভীতি সৃষ্টির জন্য সাউন্ড গ্রেনেড, চকলেট বোমা, পটকা, নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি হাতবোমা সংগ্রহ, গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে কমপক্ষে তিনটি করে হাতবোমা নিক্ষেপ নিশ্চিত করা, আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশের ওপর গুপ্ত হামলার পরিকল্পনা করা হয়।
পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে, নাশকতাকারীদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হবে। তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখা হবে।
পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাবলয় : পুলিশ সদরদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন বলেন, সারাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলো ঘিরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম স্তরে প্রতিটি কেন্দ্রের ভেতর থাকবে পুলিশ ও আনসারের ১৫-১৬ জনের দল। দ্বিতীয় স্তরে কেন্দ্রের বাইরে থাকবে টহল দল। তৃতীয় স্তরে থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স।
তারা কেন্দ্রের আশপাশে অবস্থান করবে এবং কেউ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত করার চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেবে। এর বাইরে চতুর্থ স্তরে থাকবে রিজার্ভ ফোর্স। কোনো ধরনের গোলযোগ দেখা দিলে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে।
এছাড়া সংঘাতময় পরিস্থিতি বা অন্য কোনো প্রয়োজনে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত থাকবে পুলিশের আরেকটি দল। তিনি জানান, সারাদেশে ১ লাখ ৭৫ হাজার পুলিশ সদস্য নির্বাচনী নিরাপত্তায় কাজ করছেন।
সারাদেশে র্যাবের ৭০০ টহল : র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে র্যাবের দুটি টহল দল ও দুটি স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকছে।
এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ আসনগুলোয় থাকছে বাড়তি ফোর্স। সারাদেশে প্রায় ৭০০ টহল দল কাজ করছে। এর পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতির জন্য ডগ স্কোয়াড, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট এবং হেলিকপ্টার প্রস্তুত আছে। সেই সঙ্গে সাদা পোশাকে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। অনলাইনেও নজরদারি চলছে।
মাঠে ১১৫৫ প্লাটুন বিজিবি : নির্বাচন ঘিরে যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীতে বিজিবির নির্বাচনী বেজ ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান তিনি।
নাজমুল হাসান বলেন, নির্বাচনে সারাদেশে ১ হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ৪৮৭টি বেজ ক্যাম্প থেকে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের ৭০০ টহল দল দিনরাত কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিজিবির র্যাপিড অ্যাকশন টিম ও ডগ স্কোয়াড কাজ করছে। প্রস্তুত আছে কুইক রেসপন্স টিম। যে কোনো প্রয়োজনে এই টিমের সদস্যরা হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাবেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা সাদা পোশাকে তথ্য সংগ্রহ করছেন, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নাশকতা প্রতিরোধে বিজিবি প্রস্তুত রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে সন্দ্বীপে প্রথমবারের মতো বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
৫ লাখ ১৭ হাজার আনসার মোতায়েন : নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারাদেশে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ জন আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক।
তিনি বলেন, উপকূলের ১৩টি উপজেলা বাদে সব উপজেলায় আনসার ব্যাটালিয়নের একটি করে স্ট্রাইকিং টিম নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে মোট ১২ জন করে আনসার ও ভিডিপি সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
তাদের মধ্যে একজন প্লাটুন কমান্ডার ও একজন সহকারী প্লাটুন কমান্ডারের নেতৃত্বে ছয়জন পুরুষ ও চারজন নারী ভিডিপি সদস্য থাকবেন। পিসি ও এপিসিরা অস্ত্র এবং ভিডিপি সদস্যরা লাঠি হাতে দায়িত্ব পালন করবেন।
ফায়ার সার্ভিসের মনিটরিং সেল : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচনকালীন সহিংসতায় অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় মনিটরিং ও কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন করা হয়েছে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে সেলের ০১৭৩০৩৩৬৬৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করা যাবে।
এর আগে নির্বাচনী এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় গত ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি মোতায়েন করা হয়। আর ৩ জানুয়ারি মাঠে নামে সশস্ত্র বাহিনী।
উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনাসহ ১৯ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছে নৌবাহিনী। সমতলে সীমান্তবর্তী ৪৫ উপজেলায় এককভাবে দায়িত্ব পালন করছে বিজিবি।
সেইসঙ্গে সীমান্তবর্তী ৪৭ উপজেলায় সেনাবাহিনী বিজিবির সঙ্গে এবং উপকূলীয় চারটি উপজেলায় কোস্টগার্ডের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করছে। বিমানবাহিনী দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় হেলিকপ্টার সহায়তা দেবে।
এ ছাড়া দেশের উপকূলীয় ছয় জেলার ১১টি আসনে তিন হাজারের বেশি নৌবাহিনী সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :