এমন গরম কেন, বাঁচার পথ কী?

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৩, ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
এমন গরম কেন, বাঁচার পথ কী?

ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি

ঢাকা : আলোচনা এখন গরম নিয়ে। আরবের মরুর দেশের চেয়ে দেশের তাপমাত্রা কত বেশি, চলছে সেই তুলনা। জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে অগ্নিবায়ু। গরম নিয়ে সতর্কতা জারি করছে আবহাওয়া অফিস, কখন বৃষ্টি হবে, অপেক্ষায় মানুষ।

দরকার না পড়লে বাসা থেকে মানুষ বের হচ্ছে কম, কর্মদিবসেও সড়ক অনেকটা ফাঁকা, যাত্রীর জন্য ডেকে হয়রান বাস শ্রমিকরা।

গ্রীষ্ম ঋতু এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে গরমের বার্তাই নিয়ে আসে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি কি বেশি অসহনীয় হয়ে উঠছে? হলে সেটি কেন- এসব প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছে মানুষ।

ঢাকার মিরপুরের পূরবী এলাকায় রিকশা চালিয়ে আয় করা সুজন মিয়া কাঠফাটা গরম সহ্য করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, জানটা বাইরায়া যাইতাছে। কী করুম? রিকশা না চালাইলে তো পেট চলব না। গরিব মাইনষের কি আর গরম-শীত আছে?

বেসরকারি চাকরিজীবী মাহফুজ আহমেদ বলেন, অফিসের জন্য রাস্তায় বের হলে মনে হয় গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে। গরমটা একদম সহ্য করতে পারছি না।

গরমের কারণে অফিস থেকে দুইদিন ছুটি নিয়েছি। আর তো নেওয়ার সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে, অনলাইনে অফিস হলে বেঁচে যেতাম।

তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ ধরা হয়। ৩৮ ডিগ্রির বেশি ও ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত সেলসিয়াসকে বলা হয় মাঝারি এবং ৪০ এর বেশি ও থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রাকে বলা হয় তীব্র তাপপ্রবাহ। এর বেশি হলে তাকে বলা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।

গত বছর পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড।

এ বছরও কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত দুদিন পাবনা ও চুয়াডাঙ্গায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।

দেশের কমবেশি ৮০ শতাংশ এলাকায় গরম মাত্রা ছাড়িয়েছে। আরো অন্তত তিন দিন এ অবস্থা চলার বার্তা দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।

তীব্র কষ্টে মানুষ

প্রচণ্ড গরমে গত দুই দিনে দেশে অন্তত পাঁচজন মারা গেছেন। স্কুল-কলেজে সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এই পথে কেন হাঁটল না, তা বুঝে উঠতে পারছেন না শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান। তিনি বলেন, “স্কুল-কলেজ বন্ধ দিয়ে দিয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে, অথচ আমাদের সরাসরি ক্লাস হচ্ছে। আজকেও প্রেজেন্টেশন হয়েছে।

ভার্সিটিতে যেতে-আসতে গরমে বাসে অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাসে অনেক সময় সিট পাই না, তখন দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এত গরমে বের হতে ইচ্ছা করে না একদম। রোদে গেলেই মাথা ব্যথা শুরু হচ্ছে। তারপরও ভার্সিটিতে যেতে হচ্ছে।

তীব্র গরমে মাথা ব্যথা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় অফিস করতে পারছেন না এনজিওকর্মী রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, রোদে খুব মাথা ব্যথা ছিল। তারপর পেট খারাপ শুরু হল, এরপর এল জ্বর। এই ভ্যাপসা গরমে টেকা যাচ্ছে না। রাতে একদম ঘুমাতে পারছি না। ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছি।

তীব্র গরমের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দিতে গিয়ে হয়রান হতে হচ্ছে সাইফুল ইসলামকে।

একটি কোম্পানির ডেলিভারি ম্যান সাইফুল বলেন, রোদের মধ্যে সাইকেল চালাতে অনেক কষ্ট হয়। মাথাটা পুড়ে যায়। দুপুরবেলা একেবারে অসহ্য লাগে, আত্মাটা বের হয়ে যায়।

কিন্তু এছাড়া তো আমার আর উপায় নাই। ক্যাপ পরছি, কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখছি, সানগ্লাস পরছি। তারপরও তাপ এড়ানো যাচ্ছে না।

তাপমাত্রা এমন অসহনীয় হয়ে উঠল কেন

এপ্রিল এমনিতেই দেশের উষ্ণতম মাস। চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরুতে গরমের তীব্রতায় হাঁসফাঁস করতে হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শেষ তিন দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের তুলনায় উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিপাত ও শীতের দিন কমছে, বছরের বড় অংশজুড়ে গরমের বিস্তার বাড়ছে। গড় তাপমাত্রা বেড়ে এপ্রিল মাস আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

২০২৩ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি গরমের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। গত বছর অবশ্য পুরো পৃথিবীরই সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল।

এ বছরও আরও বেশি গরমের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হতে পারে বলে সতর্ক করছেন আবহাওয়াবিদরা।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদের মতে, গত বছর বাতাসে আর্দ্রতা কম ছিল। এবার আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে মানুষের শরীর ঘামছে, অস্বস্তি বেশি হচ্ছে।

এই সময়ে পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। এবার বৃষ্টিপাত কম। কালবৈশাখী এবং বৃষ্টি না থাকার কারণে এবার গরমের তীব্রতা বেশি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলছেন, গরমের সঙ্গে এপ্রিলে সাধারণত বজ্রঝড়ও হয়ে থাকে। এ বছর বজ্রঝড় না হওয়ায় বৃষ্টি হচ্ছে না।

পশ্চিমা ঝঞ্ঝার কারণে যে বজ্রঝড় হয়, সেটা ভূমধ্যসাগর থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তানের ওপর দিয়ে এসে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্পের সঙ্গে মিশে বজ্রঝড় সৃষ্টি করে।

জলীয়বাষ্প পুঞ্জীভূত হয়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা। সেটি পুঞ্জীভূত না হয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এ কারণেই গরম বেশি পড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন ফাতিমা আক্তারের পর্যবেক্ষণ, সারা বছরের বৃষ্টিপাতের ১০ শতাংশ বৃষ্টি হয় গ্রীষ্মে। এবার এখনও সেভাবে বৃষ্টি হয়নি।

জলবায়ুর পরিবর্তন তো আছেই। মনুষ্যসৃষ্ট কারণ যেমন- গাছপালা কেটে ফেলা, গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাশয় ভরাটের কারণেই দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গরম বৃদ্ধিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অংশ হিসেবে দেখেন।

তিনি বলছেন, বাংলাদেশে এতটা নগরায়ন হয়নি, যার প্রভাবে পরিবেশ এত গরম হয়ে উঠবে। বরং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফল ভোগ করছে বাংলাদেশের মানুষ।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একদিকে শীতের প্রকোপ বাড়ছে, অন্যদিকে গ্রীষ্মের দাবদাহও অনুভূত হচ্ছে। সারাবিশ্বেই কার্বন নিঃসরণের জন্য এখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরায়ন, শিল্পায়ন, ইটভাটা, যানবাহনের ব্যবহার বেশি- এগুলো তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

বাঁচার পথ কী?

তীব্র গরমে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বের হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তবে ভবিষ্যতের বিপদ এড়াতে বিশেষজ্ঞরা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে বলছেন।

পরিবেশের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা এবং পরিকল্পনামাফিক শিল্পায়ন ঘটানোর ওপর জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, শহরাঞ্চলে সবুজের আচ্ছাদন বাড়াতে হবে। খোলা জায়গা যেমন- পার্ক, মাঠ বাড়াতে হবে। নগর পরিকল্পনায় সবুজ এবং জলভাগের পরিমাণ বাড়াতে পারলে ভালো। ভবন নির্মাণে বায়ুপ্রবাহ, সূর্যতাপ- এগুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার আবহাওয়ার এই পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুপাখি ও ফসলের সুরক্ষায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, বস্তা ভিজিয়ে গরুকে পেঁচিয়ে রাখতে হবে। নইলে গরু মারা যাবে। হাঁস, মুরগির যত্ন নিতে হবে। কৃষকদের সতর্ক থাকতে হবে। এসময় ধান পুড়ে যেতে পারে। সেজন্য পানি দিয়ে রাখতে হবে।

সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, গরম শেষ হয়ে যখন জলীয় বাষ্প আসবে, তখন প্রচুর বজ্রঝড় হতে পারে। তখন ঘরে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাতে প্রাণহানি হতে পারে।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয়

দেশে চলমান তাপদাহের কারণে জনজীবনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইসিডিডিআর,বি কিছু পরামর্শ দিয়েছে।

# দিনের বেলায় যথাসম্ভব বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, রোদ এড়িয়ে চলতে হবে;

# বাইরে বের হলে ছাতা, টুপি/ক্যাপ বা কাপড় দিয়ে মাথা যথাসম্ভব ঢেকে রাখতে হবে;

# হালকা রঙের ঢিলে ঢালা এবং সম্ভব হলে সুতির জামা পরতে হবে;

# প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে;

# সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বাসি, খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে;

# দিনের বেলায় একটানা শারীরিক পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকতে হবে;

# সম্ভব হলে একাধিকবার পানির ঝাপটা নিতে বা গোসল করতে হবে;

# প্রস্রাবের রঙের দিকে নজর রাখতে হবে, তা হলুদ বা গাঢ় হলে অবশ্যই পানি পানের পরিমাণ বাড়াতে হবে;

# ঘরের পরিবেশ যেন অতিরিক্ত গরম বা ভ্যাপসা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে;

# বেশি অসুস্থবোধ করলে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এমটিআই

Link copied!