গ্যাসসংকটে বেড়েছে লোডশেডিংও, চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৪, ১১:২০ এএম
গ্যাসসংকটে বেড়েছে লোডশেডিংও, চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

ঢাকা : চট্টগ্রামে এলএনজি পাইপলাইন লিকেজ হওয়ার কারণে চলমান গ্যাসসংকট আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। গ্যাসের অভাবে কমেছে বিদ্যুতেরও উৎপাদন। 

একদিকে গ্যাসসংকট, অন্যদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ফলে বাসাবাড়ি, কারখানা, সিএনজি স্টেশনসহ সবক্ষেত্রে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইনের ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শুক্রবার (১২ জুলাই) বিকেল নাগাদ গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কর্ণফুলী নদীতীর থেকে ৫০০ মিটার দূরে মাটির ১০ মিটার গভীরে পাইপলাইনটির অবস্থান। পানির কারণে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে কাজটা করা বেশ জটিল।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কবলে পড়ে গত ২৭ মে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যায় সামিটের টার্মিনালটি। এতে ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ কমে যায়। এরপর ওই পাইপলাইন দিয়ে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২৫ কোটি ঘনফুটের বেশি সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

দেশে দৈনিক ৪২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে দেশীয় এবং আমদানি করা এলএনজি মিলে সরবরাহের সক্ষমতা গড়ে ৩১০ কোটি ঘনফুট। এখন সেটি নেমে এসেছে ২২৫ কোটি ঘনফুটে।

গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসসংকটে ভুগতে থাকা কারখানাগুলোর উৎপাদন কমার পাশাপাশি বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে রান্নার চুলা ঠিকমতো জ¦লছে না।

রাজধানীর দনিয়া এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা দিলরুবা আক্তার সুমী বলেন, এমনিতেই তার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসসংকট চলছে। কয়েক দিন ধরে সংকট আরও বেড়েছে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চুলায় গ্যাস থাকে না। বিকেলের দিকে কিছু সময়ের জন্য গ্যাস এলেও চাপ কম থাকায় চুলা জ্বালানো যায় না। বৈদ্যুতিক চুলা থাকলেও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে সময়মতো রান্নাও করা যায় না। বেশিরভাগ দিনই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খেতে হয়।

গ্যাসসংকটে রাজধানীর সিএনজি স্টেশনগুলোয় গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষার পরও গাড়িতে ঠিকমতো গ্যাস ভরতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, এমনিতেই সিএনজি স্টেশনগুলোয় অনেক দিন ধরে ঠিকমতো গ্যাস পাওয়া যায় না। এখন সেই সংকট আরও বেড়েছে। দিনে গ্যাস থাকে না। রাতে পাওয়া গেলেও প্রয়োজনীয় চাপ থাকে না। মেশিন চলছে কিন্তু গ্যাস দিতে পারছি না। আর বিদ্যুৎ বিল ও অন্য খরচ ঠিকই দিতে হচ্ছে। অনেক স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো গ্যাসের অভাবে ধুঁকছে।

গ্যাসসংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় দৈনিক অন্তত ১১০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৭৫ কোটি ঘনফুট। আগে যেখানে গ্যাসের অভাবে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হতো, এখন সেটি প্রায় চার হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।

বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন-সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে গড়ে সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারার কারণে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কারিগরি ত্রুটির কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে কয়লা ও তেলচালিত বিদ্যুৎ দিয়ে সর্বোচ্চ যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন কমেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ইপিজেডের জেটি নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষার সময় জিটিসিএলের (গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড) আনোয়ারা-ফৌজদারহাট ৪২ ইঞ্চি এলএনজি পাইপলাইনটি লিকেজ হয়ে যায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে ওই দুর্ঘটনার পর খবর পেয়ে সেখানে জিটিসিএলের কর্মকর্তারা উপস্থিত হন। বুধবার সকাল থেকে শুরু হয় মেরামত কাজ।

জিটিসিএলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইপিজেডের কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রোড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সাব-কনট্র্রাক্টর ‘ফাস্ট হারবার কনস্ট্রাকশন’ ওই পাইপলাইনটি ফুটো করে ফেলে। এ ধরনের কাজ করার জন্য যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার, তারা তা করেনি। 

গ্যাস পাইপলাইন স্পর্শকাতর হওয়ায় সড়ক, মহাসড়ক বিভাগ বা অন্যরা কাজ করার আগে আমাদের জানায়, তখন তাদের পাইপের অবস্থানের তথ্য দিলে সে অনুযায়ী তারা কাজ করে। কিন্তু চীনা প্রতিষ্ঠান জিটিসিএলকে কিছু না জানিয়েই সেখানে রিগ চালিয়েছে।

পেট্রোবাংলার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তিতাস ও বাখরাবাদ এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন মেরামতের কাজ চলছে। গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আরও কিছু অঞ্চলে গ্যাস দেয় বাখরাবাদ। আর ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বড় অংশের গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস।

এমটিআই

Link copied!