শেষ বাজি হারাল সংঘাতে, কী হবে সবুজের পরিবারের

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৪, ১১:২৭ পিএম
শেষ বাজি হারাল সংঘাতে, কী হবে সবুজের পরিবারের

ঢাকা : সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারানো ছাত্রলীগ কর্মী সবুজ আলীকে পড়াতে গিয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তে বড় ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কারণ, ভূমিহীন পরিবারটির পক্ষে একসঙ্গে দুই জনের পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না।

বুধবার (১৭ জুলাই) সেই বড় ভাই নুরুন্নবী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছোট ভাইয়ের রক্তাক্ত মরদেহ দেখে হতভম্ভ হয়ে পড়েন। যে ভাইকে ঢাকায় এনেছিলেন উন্নত জীবনের আশায়, তার লাশ বাড়িতে নিয়ে মা-বাবাকে কী বলবেন সেই চিন্তাও তার মনে।

হাসপাতালের মর্গের দরজায় ভিড়ের মধ্যে হাঁক এল, সবুজ আলীর গার্ডিয়ান আছেন কেউ?

চেক শার্ট পরা পাতলা গড়নের নুরুন্নবী ছুটে গেলেন ভেতরে; কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে এসে ভিড়ের সঙ্গে দাঁড়ালেন। তার কাছ থেকেই জানা গেল পরিবারটির জীবন সংগ্রামের কাহিনি।

নীলফামারীর ভূমিহীন কৃষকের সন্তান সবুজ আলী ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র ছিলেন, যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।

নুরুন্নবী জানান, ভাইবোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়, সবুজ দ্বিতীয়। একটা বোনের বিয়ে দিয়েছেন। আরেকটা বোন এখনো লেখাপড়া করছে, তবে তার মানসিক অসুস্থতা দেখা দিয়েছে।

পরিবারটির প্রধান বাদশা আলী ভূমিহীন কৃষক। আট শতাংশের ভিটাবাড়িটি ছাড়া তাদের আর কোনো জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে তিনি চার ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন। সেই সঙ্গে ভ্যান চালাতেন। কিন্তু সেই ব্যানও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল সবুজের জন্য।

নুরুন্নবী ও সবুজ আলী লেখাপড়া করতেন। এইচএসসি পাসের পরে নুরুন্নবী টঙ্গীতে এসে আট হাজার টাকা বেতনে টঙ্গীতে একটি ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিতে যোগ দেন, পাশাপাশি ভর্তি হন ডিগ্রিতে।

কিছুদিনের মধ্যেই সবুজ নীলফামারীর ডোমার কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি লেখাপড়ায় অনেক ভালো করছিল দেখে পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকেই সুযোগ করে দেওয়া হয়। নুরুন্নবী হাসিমুখে মেনে নেন সে সিদ্ধান্ত।

সবুজের খুব ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। ভাইয়ের পড়ার খরচ যোগাতে কম বেতনের কিন্তু কম পরিশ্রমের চাকরিটি ছেড়ে একটু বেশি বেতনে গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ কারখানার কঠোর পরিশ্রমের একটা চাকরি নেন নুরুন্নবী।

তিনি বলেন, একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে ফরম কেনা থেকে যাওয়া-আসা, থাকা মিলিয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ। আমি অনেক কষ্ট করে টাকাগুলো যোগালাম।

জাহাঙ্গীরনগরে ও (সবুজ) একটুর জন্য ওয়েটিংয়ে ছিল। ওরা বলেছিল অনলাইনে খেয়াল রাখতে। কিন্তু তখন আমাদের এমন অবস্থা, অনলাইনে দেখতে যে টাকাটা লাগে সেটা যোগানোই কঠিন হয়ে গেল। ওর পরের সিরিয়ালে ভর্তি হয়ে গেল, ওর আর সেখানে ভর্তি হওয়া হল না। পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হল।

নুরুন্নবী কিছু টাকা পাঠাতেন, ছাত্র পড়িয়ে ও খণ্ডকালীন টুকটাক চাকরি করে একেকটি বছর পার করেছেন সবুজ, সেই সঙ্গে উজ্জ্বল হচ্ছিল পরিবারের আশা।

আর একটা মাত্র ইনকোর্স পরীক্ষা বাকি ছিল। মা খুব বলত সবুজ সংসারের হাল ধরলে আমার কষ্টটা কমবে। কিন্তু কী হয়ে গেল দেখেন!

গলা ধরে আসে নুরুন্নবীর, চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন মর্গে আসা ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষক, সবুজের সহপাঠীরা।

কিন্তু পরিবারটির সর্বস্ব আশা-ভরসার বিনিয়োগ যেখানে সেই ভাইটির লাশ বাড়ি নিয়ে মা-বাবাকে কী বলবেন সেই চিন্তায় কিছু ভালো লাগছিল না নুরুন্নবীর।

তিনি বলছেন, ভাইটাকে ঢাকায় আনছিলাম পড়াশোনা করে ভালো কিছু করবে। অন্তত বাপ-মাকে একটু ভালো রাখবে সেই আশা ছিল। এখন তার লাশ আমি কীভাবে নিয়ে যাব?

খবরটা শোনার পর থেকে মা পাগলের মত।

সবুজের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল থেকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে, সেখানে তার জানাজায় অংশ নেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।

নুরুন্নবী সেখানেও তার পরিবারের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ভাইকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সে স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। …আমার ভাইয়ের হত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চাই।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মঙ্গলবার ছাত্রলীগের সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকা কলেজের সামনে পড়েছিল সবুজের মরদেহ। মধ্যরাতে সিআইডির একটি দল মরদেহের আঙুলের ছাপ ডেটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে তার পরিচয় শনাক্ত করে।

ঢাকা কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের ১৮/১৯ সেশনের ছাত্র ছিলেন সবুজ; থাকতেন কলেজের নর্থ হলে।

নীলফামারীর সদর উপজেলার আরাজি দলুয়া গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন তিনি।

বাবার বাদশা মিয়া বর্গা চাষি আর মা সূর্য বানু মানুষের বাড়িতে কাজ করে আয় করেন বলে জানিয়েছেন নুরুন্নবী।

ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনও সবুজের পরিবারের জন্য কোনো সহযোগিতার ঘোষণা আসেনি।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেছেন, হত্যার শিকার পরিবারগুলোর জীবিকার ব্যবস্থা সরকার করবে।

‘আমি কত দুঃখিনী মাও, হামার বেটাক ফিরাই দাও’

দুপুরে নীলফামারী জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সবুজের মা সূর্য বানু কেঁদে চলছেন, সেই সঙ্গে জরাজীর্ণ ঘরের বিছানায় শুয়ে ছেলেকে প্রলাপ বকছেন।

আমার পুত কো, আমার বেটা কো দয়াল আল্লাহ, আমার বেটাক দেও গো, আমার কাছে ফিরাই দেও।

ও বাবারা আমার বাকাটাক আইনা দেও। আমার বেটাক আইনা দেও বাবা। আমি কত দুঃখিনী মাও, আমি কত দুঃখ-কষ্ট কইরা বেটাক লেখাপড়া করাইছি। আমার বেটাক দেও গো আমার বেটাক।

সূর্য বানু কখনো কাজ করেন অন্যের বাড়িতে, কখনো করেন ভিক্ষা। স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলে লেখাপড়া শিখে একটি ভালো চাকরি করে হাল ধরবে সংসারের।

আহারে কইলজার টুকরা, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ কইরা, ভিক্ষা কইরা খিলায়া আমি সন্তানের লেহাপড়া করাইছি গো। হামার এই সন্তানের বিচার আমি চাই, ন্যায্য বিচার আমি চাই।

হামার সন্তানকে কী করল, হামার সন্তান আমি চাই, আমার বেটা চাই। হামার সন্তান কোনোদিন গ্রামে নাড়াই (ঝগড়া) করে নাই, আমার সবুজ শান্ত।

সূর্য বানুর বিলাপ আর শেষ হচ্ছিল না।

সবুজের ছোট ভাই শাহ সুলতান জানান, গত ১৩ জুলাই সকাল পৌনে আটটার দিকে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল পরিবারের সঙ্গে ভাইয়ের। সেদিন নিজে ফোন করে সবার খোঁজখবর নিয়েছেন। জানিয়েছিলেন ভালো থাকার কথা।

প্রতিবেশীরা জানান, গত দুই মাস আগে সবুজের টাকার প্রয়োজন পড়ায় অবলম্বনের ভ্যানটি বিক্রি করে দেন বাবা বাদশা আলী। ছেলের মৃত্যুর খবর আসার সময় তিনি শ্রমিকের কাজ করতে ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলায়।

প্রতিবেশী হাফিজুল ইসলাম বলেন, তার (সবুজ) বাবা ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্টে ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগান দিচ্ছিলেন। তার বাবা দিনমজুরির কাজে মানিকগঞ্জ জেলায় আছেন। ছেলের মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য আমরা মোবাইলে তাকে চেষ্টা করে পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সে স্বপন আর পূরণ হলো না পরিবারের।

আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দেখছেন আসাদুজ্জামান নূর

দুপুরে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নীলফামারী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “সবুজ আলীকে ঘিরে ওই পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা কিন্তু এক নিমেষে নিভে গেল।

একটা ছাত্রলীগের কর্মীকে কারা হত্যা করতে পারে? নিশ্চয়ই দেশবিরোধী শক্তি।

কোটা আন্দোলন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগও এনেছেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা। তিনি বলেন, আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, যখন কিছু ঘটেনি, তখন মার্কিন সরকার ঘোষণা দিল এখানে দুইজন নিহত হয়েছেন। এ বিষয়ে তাদের এত আগ্রহ কেন?

নির্বাচনের আগেও তাদের অতিমাত্রায় আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। এখন আবার তারা মাঠে নেমেছেন। এসব কিছুর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করছি। আমরা দেশবাসীকে বলতে চাই, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি। আমরা সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করি।

ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে সবুজ আলী হত্যার বিচার দাবিতে বুধবার বিকেলে জেলা শহরে বিক্ষোভ করা হয়। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Link copied!